Rakhi Purnima 2023 : রাখীবন্ধনের শিকড় কোথায়? কী বলে ভারতের ইতিহাস? লোককথা বা মহাকাব্যেই বা কীভাবে উল্লেখ?
Rakhi Bandhan 2023: রাখীবন্ধন মানে আরও বেঁধে বেঁধে থাকার প্রতিশ্রুতি। কী বলে আমাদের দেশের মহাকাব্য ? কী বলে লোককথা ? শিকড় খুঁজলেন শিক্ষাবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি
রাখী পূর্ণিমা (Raksha Bandhan) । বাংলার মাটিতে এই উৎসব শুধু ভাই-বোনের নয়। রাখী হল সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন। সম্প্রীতির সুতো। বেঁধে বেঁধে থাকার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু কী বলে আমাদের দেশের মহাকাব্য ? কী বলে লোককথা ? (Rakhi Purnima)
আমাদের দেশে রাখীর উৎসব পালিত হয় শ্রাবণী পূর্ণিমায়। শিক্ষাবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি এবিপি লাইভকে জানালেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই উৎসবকে শ্রাবণীও বলা হয়। এর শিকড় খুঁজতে গেলে বেদ -উপনিষদের থেকেও বেশি সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় লৌকিক আচারের মধ্যে। মানুষ এই শ্রাবণীর দিনটিকেই বেছে নিয়েছেন বন্ধনের উৎসব পালনের জন্য। (Rakhsha Bandhan celebration)
উত্তর ভারতে এই উৎসব মূলত পালিত হয় ভাই-বোনের মধ্যে। সেই ঐতিহ্য রাজ্য থেকে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ইতিহাসে এই উৎসবকে আমরা পাই, সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে। শিক্ষাবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি এই প্রসঙ্গে তুলে ধরলেন রানি কর্ণাবতী ও মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের গল্প। এমন কাহিনি শোনা যায়,গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ যখন চিতোর আক্রমণ করছেন তখন দিল্লির বাদশার কাছে সাহায্য চেয়ে রাখী ও পত্র পাঠান বিধবা রানি। অর্থাৎ রাখী পাঠিয়ে রক্ষা-প্রার্থনা। কিন্তু হুমায়ূন যখন সেই রাখী গ্রহণ করে সেনা পাঠালেন চিতোরকে বাঁচাতে, তখন তো সব শেষ ! জওহর ব্রতয় প্রাণ দিয়েছেন রানি কর্ণাবতী। কিন্তু রক্ষাবন্ধনের কথা রাখতে বাহাদুর শাহকে হারিয়ে চিতোর উদ্ধার করেন হুমায়ূন। সিংহাসনে বসান কর্ণাবতী পুত্রকে।
শুধু ইতিহাসে নয়। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বললেন, মহাকাব্যেও রয়েছে রক্ষাবন্ধনের উল্লেখ। শোনা যায় শিশুপাল বধের সময় সুদর্শন চক্রে শ্রীকৃষ্ণের কনিষ্ঠ আঙুলটি কেটে যায়। রক্ত পড়তে দেখে ছুটি আসেন কৃষ্ণ-সখী কৃষ্ণা, দ্রৌপদী। দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচল খানিকটা ছিঁড়ে তাঁর হাতে বেঁধে দেন। সেই থেকেই শ্রীকৃষ্ণ কৃষ্ণাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। যখন ভরা রাজ সভায় দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে মেতে উঠেছিল, সেই সময় ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভাব ঘটে পার্থসারথিরই। দ্রৌপদীর লজ্জানিবারণ করেন চিরসখা।
লক্ষ করলে দেখা যাবে এই যে কাপড় বেঁধে দিয়েছিলেন দ্রৌপদী, তা তৈরি হয় কাপাস তুলোর সুতো দিয়ে। অর্থাৎ সেই সুতোর বন্ধন। আবার প্রাচীনকালে উপাকর্ম বলে একটি প্রথা প্রচলিত ছিল। বিশেষ এই দিনে ব্রাহ্মণরা তাঁদের উপবীত বদলাতেন। উপবীতও কিন্তু পবিত্র সুতোর বন্ধনই। এইভাবেই রক্ষাবন্ধনের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে এক হয়ে যায় লোকাচার, মহাকাব্য, কিংবদন্তী।
আবার একটু অর্বাচীন পুরাণ ঘাঁটলে রাখী সংক্রান্ত আরেকটি কাহিনি প্রচলিত আছে বলে জানালেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি । শ্রাবণী পূর্ণিমা বা ঝুলন পূর্ণিমার দিন রাজা তাঁর পিতৃপূর্বের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। রাজা সেদিন যেখানে বসতেন, সেখানে উপস্থিত থাকতেন সব বর্ণের মানুষেরা। এমনকী সেদিন হাজির থাকতেন দেহপসারিণীরাও। অর্থাৎ সব ধরনের মানুষের সমাগম হত। সেদিন উপাচার শুরুর আগে রাজ পুরোহিত রাজার হাতে বেঁধে দিতেন একটি সুতো, যার মাধ্যমে তাঁর শুভকামনা করা হত। তারপর সেখানে উপস্থিত সব মানুষের হাতেই সুতো বাঁধা হয়। সেটাও তো একরম রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি। সমাজে রাজার আশ্রয়ে সকলের সুরক্ষিত থাকার বার্তা দেওয়া হত এই সুতো বাঁধার মাধ্যমে।
রাখী নিয়ে নানারকম কাহিনি লোকের মুখে মুখে ফেরে। তবে একটি বিষয় প্রনিধান যোগ্য। যুগ যাই হোক না কেন, রাখী বরাবর বন্ধনের কথাই বলেছে। সেই বন্ধন ভাই-বোনের ভালবাসার হোক কিংবা নিরাপত্তার বা সম্প্রীতির। রাখী উৎসবের মাধ্যমে সেই সৌভ্রাতৃত্বের ভাবকেই বাংলার জন গণ মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ । বঙ্গভঙ্গের আইনের বিরুদ্ধে সকলকে একযোগে করে রুখে দাঁড়াতে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ বসু, শ্রী সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শ্রী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, শ্রী বিপিনচন্দ্র পাল ডাক দিয়েছিলেন ঐক্যবন্ধনের। শহরজুড়ে বিলি হয়েছিল প্রচারপত্র। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর, ৩০শে আশ্বিন বাঙালির ঐক্যবন্ধনের দিন ঘোষিত হয়েছিল। সকলের হাতে রাখি পরিয়ে সংযম গ্রহণের ডাক দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের গানে তো আমরা রাখীকে ভালবাসার বন্ধন হিসেবেও পাই। ' মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো, আমার হাতের রাখী-- তোমার কনককঙ্কণে '। রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, তোমার হাতের রাখীখানি বাঁধো আমার দখিন-হাতে।
মহাকাব্য, পুরাণ, ইতিহাসে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রাখীবন্ধন সংক্রান্ত যে কাহিনিগুলি উঠে এসেছে, তা বেশির ভাগই বহুশ্রুত ও প্রচলিত। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়। রাখী বা রক্ষাবন্ধন, উৎসবকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এই আচার কিন্তু সর্বোপরি বন্ধন ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার কথাই বলে। যুগ যুগ ধরে। কাল কাল ধরে।