এক্সপ্লোর
Advertisement
হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, এখনও মেলায় মেলায় দেখা যায় বাংলার প্রাচীন পুতুল তালপাতার সেপাই
গোপীনাথ জানালেন, যাঁরা মূলত তালপাতার হাতপাখা, পুজোর পাখা তৈরি করেন তাঁরাই তৈরি করেন এই পুতুল। ১০০ পুতুল বানাতে ২-৩ দিন লাগে।
হাওড়া: রাবার আর প্লাস্টিকের আনব্রেকেবল পুতুলের যুগে এর কদর আর নেই। তবু পুরনো সব মেলায় যদি যান, তবে দেখবেন, একজন ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যাঁর কাঁধে একটা বাঁশের লাঠি। তার ওপর মোটা খড়ের গদি। আর তাতে গুঁজে রাখা অজস্র লিকপিকে পুতুল। যা হাত পা নাড়তে পারে ইচ্ছেমত।
এগুলোই তালপাতার সেপাই। শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকেও নাকি এই পুতুলের উল্লেখ রয়েছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে এর বয়স কয়েক হাজার বছর। আবার অনেকে বলেন, সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকে এই পুতুল তৈরি শুরু হয়, তাই পুতুল জোড়ার একটা সাহেব পুতুল আর একটা মেম। এর রোগাপটকা চেহারা নিয়ে প্রবচনও বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই প্রবচন অমরত্ব পেলেও তালপাতার সেপাই এই বিশ্বায়নের যুগে আর কতদিন বেঁচে থাকবে বলা যাচ্ছে না। যাঁরা বংশপরম্পরায় এই পুতুল বানাতেন, তাঁরা অনেকেই বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। কারণ খুব সহজ। এই পুতুল বিক্রি করে পেট চলে না।
কেমন করে তৈরি হয় তালপাতার সেপাই? দুটো তালপাতা থাকে, একটা ওপরে, একটা নীচে। এই দুটো কেটে তৈরি হয় মাথা হাত পা। জোড়া থাকে একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে। কাঁথা সেলাইয়ের সুতো দিয়ে সেলাই করে দেওয়া হয়। এই পুতুলের মজা হল, বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে কঞ্চি নাড়ালেই পুতুল ইচ্ছেমত হাত পা নাড়ায়, দেখে দারুণ মজা পায় বাচ্চারা।
আগে ছোটরা যখন মাটির পুতুল নিয়ে খেলত, তখন তাদের সঙ্গ দিত এই তালপাতার সেপাইও। পুরনো মেলাগুলোতে স্মরণাতীতকাল থেকে এই পুতুল বিক্রি হয়। হাওড়ার আন্দুলের খটিরবাজার ১ নম্বর পঞ্চায়েত এলাকার ওলাবিবিতলার বাসিন্দা বুধেন রায় জানাচ্ছেন, তাঁদের এই পুতুলের চোদ্দ পুরুষের কারবার। বাবা বানাতেন, ঠাকুর্দা, তাঁর বাবা- বংশপরম্পরায় তাঁরা তৈরি করে আসছেন তালপাতার হাতপাখা আর তালপাতার সেপাই পুতুল। এখন পাড়ায় তাঁরাই এক ঘর, যাঁরা এই পুতুল তৈরি করেন। আগে আরও কয়েক ঘর কারিগর ছিলেন, পুতুল, পাখা বেচে সংসার না চলায় তাঁরা সরে গিয়েছেন অন্য পেশায়। এ বছর করোনার জেরে সব মেলা, পুজো বন্ধ, তাই লোকসান হয়েছে খুব। তাই পুতুল বিক্রির পাশাপাশি দিনমজুরের কাজও করতে হচ্ছে বুধেনের ছেলে গোপীনাথকে।
গোপীনাথ জানালেন, যাঁরা মূলত তালপাতার হাতপাখা, পুজোর পাখা তৈরি করেন তাঁরাই তৈরি করেন এই পুতুল। ১০০ পুতুল বানাতে ২-৩ দিন লাগে। রং করতে হয়, শুকোতে দিতে হয়। পুতুলের কঠিন অংশ হল হাত পা, এমনভাবে সেলাই করতে হয় যাতে আঙুলের ছোঁয়াতেই নড়তে থাকে। সব থেকে বেশি এই পুতুলের বিক্রি হয় হাওড়ার রামরাজাতলার রামপুজোর মেলায়। বিয়েবাড়ি, জন্মদিনে মেনুকার্ডের জন্য এই পুতুলের আজকাল কদর হয়েছে, আবার দুর্গাপুজো কালীপুজোর প্যান্ডেলের জন্যও বিক্রি হয় একশ-দুশ থেকে হাজার-দুহাজার পুতুল। ৮-৯ টাকায় তৈরি হয় এক একটা পুতুল, সবটাই হাতে তৈরি। আসল কারসাজি লুকিয়ে থাকে কঞ্চির টানে হাত পা নাড়ার মধ্যে। আর বিক্রির জন্য দাম নেন ১০ থেকে ১৫ টাকা। তবে বিশ্ব বাংলার মত বিভিন্ন সরকারি জায়গায় হেলাফেলার এই পুতুল দাম পায় অনেক বেশি।
তবে এখন আর শিশুদের কাছে তালপাতার সেপাইয়ের কদর নেই। চিনা খেলনা ধরে ফেলেছে বাজার, প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার মৃৎশিল্পীদের তৈরি ঘূর্ণির পুতুল, কাঠের পেঁচা, টিনের খেলনা বাসনকোসন। অসম লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়েছে তালপাতার সেপাইও। যতদিন যাচ্ছে, ছেলেমেয়েদের খেলনার বাক্সে নয়, তার কদর হচ্ছে সংগ্রাহকদের কাছে। কিন্তু এভাবে কি ব্যবসায় টিকে থাকা যায়।
পুরনো দিনের মানুষরা স্মৃতি হাতড়ান, স্বদেশি আমলে গুপ্ত সমিতির যুবকরা গ্রামের মেলায় এই তালপাতার সেপাইয়ের খোঁজ করতেন। কলকাতায় সরলা দেবীর বীরাষ্টমীর মেলায় চলত লাঠি, ছুরির খেলা, বসত কুস্তির আসর। আসতেন অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা। তারই মাঝে মেলায় রমরমিয়ে বিক্রি হত তালপাতার সেপাই। বাঙালির আঙুলের দোলায় নেচে উঠত তালপাতার সাহেব পুতুল।
খবর (News) লেটেস্ট খবর এবং আপডেট জানার জন্য দেখুন এবিপি লাইভ। ব্রেকিং নিউজ এবং ডেলি শিরোনাম দেখতে চোখ রাখুন এবিপি আনন্দ লাইভ টিভিতে
আরও দেখুন
Advertisement
ট্রেন্ডিং
Advertisement
Advertisement
সেরা শিরোনাম
জেলার
খবর
ব্যবসা-বাণিজ্যের
খুঁটিনাটি
Advertisement