কলকাতা: হাতে হাত রেখে জীবনের সমস্ত চড়াই উতরাই একসঙ্গে অতিক্রম করাই তো ভালবাসা। আর জীবনের সেই সমস্ত কঠিন সময় যে একইভাবে ছায়ার মতো সঙ্গ দিয়ে চলেছে তাঁর বিশেষ দিনে একটা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট তো হতেই হয়। আজ জন্মদিন টেলি অভিনেতা সব্যসাচী চৌধুরীর। সোশ্যাল মিডিয়ায় মিষ্টি ছবি পোস্ট করে শুভেচ্ছা জানালেন প্রেমিকা ঐন্দ্রিলা শর্মা। ক্যাপশনে লিখলেন, 'জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা সব্যসাচী। অনেক ভালবাসা। আমাদের ইক্যুয়েশন এরকম থাকুক সারাজীবন।'
মাঝেমধ্যেই নিজের ফেসবুক পোস্টে ঐন্দ্রিলার স্বাস্থ্যের খবর ভাগ করে নেন অভিনেতা সব্যসাচী। এক বছরের বেশি সময় ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছেন অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা। শরীরের জন্য বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয়েছে শ্যুটিং ফ্লোর। মারণ রোগের সঙ্গে প্রেমিকার প্রতিনিয়ত লড়াইয়ের কথা ফুটে ওঠে সব্যসাচীর কলমে।
সম্প্রতি একটি ফেসবুক পোস্টে সব্যসাচী লেখেন, 'প্রতি মাসের শেষে ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে লেখাটা আমার প্রায় রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে সারা মাস ধরে বহু সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নানান পত্রপত্রিকা এবং সংবাদমাধ্যম আমায় নিয়মিত প্রশ্ন করেন ওর বিষয়ে। আমি কাউকেই বিশেষ কিছু বলি না, আসলে ‘ভালো আছে’ বলতে আমার ভয় লাগে। সত্যি বলতে, চোখের সামনে আমি যা দেখেছি এবং নিয়মিত দেখছি, সেটাতে ভালো থাকা বলে না, সেটাকে অস্তিত্বের লড়াই বলে। অবশ্য এইসব খটোমটো কথা কেবলমাত্র আমিই বলি, ওকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে তাহলে এক গাল হেসে উত্তর দেবে “খুব ভালো আছি, আমার রাশিফল ভালো যাচ্ছে।"
প্রসঙ্গত বলি, অসুস্থ হওয়ার আগে জানুয়ারি মাসে কাকে যেন হাত দেখিয়েছিলো, আমি এসবে খুব একটা বিশ্বাস করি না, তাই আমায় আগে জানায়নি। তিনি কুষ্ঠী বিচার করে বলেছিলেন, “ রাশিফল ভালো যাচ্ছে, এই বছর তোমায় নিচের দিকে তাকাতেই হবে না।” সত্যিই তাই, মাথার ওপরে সিলিং ফ্যান আর ঝুলন্ত কেমোর বোতল দেখেই ওর বছর পার হতে চলল। সে যাই হোক, দেখলাম যে জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর থেকে ওর বিশ্বাসটা প্রায় উঠে গেছে।
যা বুঝলাম, এই অসুখটার কোনো নিয়মবিচার নেই, ওষুধপত্র সবই আছে অথচ নেই, চিকিৎসার নির্দিষ্ট দিনক্ষণ আছে কিন্তু আরোগ্যের নেই। কথা ছিল সেপ্টেম্বর অবধি চিকিৎসা চলবে, ক্রমে সেটা গুটিগুটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ডিসেম্বরে। প্রতিবার যখন ডাক্তার বলেন চিকিৎসার সময় বাড়াতে, ওর মুখটা যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যায়। প্রতিবার কেমো নেওয়ার পর কয়েক রাত অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করে। শুয়ে থাকলে মনে হয়ে বুকে পাথর চেপে বসছে, আবার উঠে বসলে শ্বাস নিতে পারে না। রক্তচাপ মাঝেমধ্যেই ৮০/৪০ এ এসে ঠেকে। খাওয়ার ইচ্ছা এবং স্বাদ চলে যায়। আধখানা ফুসফুস বাদ যাওয়াতে সবটাই বড় কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে একপ্রকার অচেতন করে রাখা হয় ওই কয়েকটা দিন। তবে বাকি দিনগুলিতে দিব্যি ঠিক থাকে, পুজোর জন্য অনলাইন শপিং, আমার ওপর হম্বিতম্বি, লেজওয়ালা বাচ্চাদের তদারকি, সবটাই পরিপাটি করে পালন করে।
আরেকটা বিষয় আমি উপলব্ধি করেছি, ক্যানসার শুনলেই অধিকাংশ মানুষ মূলত দুই ভাবে প্রতিক্রিয়া দেয়। প্রথমটি হল, ক্যান্সারের কোনও উত্তর নেই। দ্বিতীয়টি হলো, “ আরে এটা কোনও ব্যাপারই না, এই তো আমার অমুকের হয়েছিল, কেমো চলাকালীন কাজকর্ম সবই করতো, এখন তো ঠিকই আছে।” বাস্তবে দুটোর কোনোটাই সত্যি নয়। প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রে অসুখটা ভিন্ন জাতের এবং ভিন্ন মাপের। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তার মাত্রা নির্ভর করে। ২০১৫ তে যখন ঐন্দ্রিলার প্রথমবার ক্যানসার ধরা পরে, প্রাথমিক বিপদ কেটে যাওয়ার পর, কেমো চলাকালীন ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতো, টিউশন যাওয়া থেকে শুরু করে স্কুটি চালানো, সবই করেছে, কিন্তু এই বার বিষয়টা একদমই উল্টো। মাঝেমধ্যে বিছানা থেকে নেমে বাথরুম যাওয়ারও জোর পায় না।
যদিও ক্রিকেট আমার পছন্দের খেলা, তবে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় অবধি আমি একটু আধটু গোলকিপিং করতাম। খুব একটা যে ভালো খেলতাম তা নয়, তবে খুব মন্দও নয়। মাঝেমধ্যে গোল খেলে বন্ধুরা খুব হাসাহাসি করতো ঠিকই, তবু আমি ভালোবেসেই খেলতাম। দুই পক্ষেই এগারোজন করে খেলে, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়, এগুলো দেখেই আমি অভ্যস্ত। কিন্তু এটা তো আর তা নয়, এ বড় অসম লড়াই। একটা তেকাঠি রক্ষা করতে পুরো দলটা কেবল লড়েই যায়, ডাক্তার, পরিবার, বন্ধু, সমাজ, সকলে। এরই ফাঁকে যে কত কাছের মানুষ অচেনা হয়ে যায়, আবার কত দূরের মানুষ নিঃস্বার্থে প্রার্থনা করে, তা হিসেবের বাইরে।
এই লড়াইয়ে কোনও নিয়ম নেই, সময়সীমা নেই, আক্রমণ নেই, কাউন্টার অ্যাটাক নেই, কেবল রক্ষণটুকু আছে। তবে খেলার মাঠেও আক্রমণ করার ক্ষমতা আমার ছিল না, এখানেও তা নেই। আমি শুধু দাঁতে দাঁত চিপে আগলাতে পারি, আমি শুধু বুঝি, গোল না খাওয়া মানে জিতে যাওয়া। খেলার মাঠের বন্ধুরা কেউই আর সেইভাবে অবশিষ্ট নেই আমার জীবনে। মাঝেমাঝে ইচ্ছা হয় তাদের ডেকে এনে বলি, একবার দেখে যা হতচ্ছাড়াগুলো, জীবনের সেরা কিপিংটা আমি এখন করছি।' (অপরিবর্তিত)