চিন, পাকিস্তানের মোকাবিলায় নৌসেনার জন্য "পি-৭৫আই" প্রকল্পকে সবুজ সঙ্কেত দিচ্ছে কেন্দ্র, সেপ্টেম্বরেই জারি বিজ্ঞপ্তি
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিনের তুলনায় আধুনিক প্রযুক্তির ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন বহুক্ষেত্রে অনেক বেশি স্টেলথ প্রমাণিত হয়... কেন তাঁরা এমনটা মনে করেন? কী ব্যাখ্যা দিলেন তাঁরা?
সুশান্ত দাস: দীর্ঘ টালবাহানার পর অবশেষে ভারতের "স্টেলথ অ্যাটাক সাবমেরিন" তৈরি প্রকল্পের পরবর্তী ধাপের প্রক্রিয়া শুরু হতে চলেছে। আগামী মাসেই ভারতীয় নৌসেনার জন্য ৬টি নতুন প্রজন্মের ডিজেল-ইলেকট্রিক চালিত স্টেলথ সাবমেরিন (পোশাকী নাম প্রজেক্ট-৭৫ ইন্ডিয়া বা ছোট করে "পি-৭৫আই") তৈরির বরাত বা রিকোয়েস্ট ফর প্রোপোজাল (আরএফপি) জারি করতে চলেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। প্রকল্পের মোট মূল্য প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা।
আমদানির পরিবর্তে ভারতে উৎপাদন করার লক্ষ্য নিয়ে মেক ইম ইন্ডিয়া উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর জন্য ২০১৭ সালে গঠন করেছিলেন স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার(এসপি) বা কৌশলগত অংশীদার পদ্ধতি। বলা যেতে পারে, এই পদ্ধতির অন্তর্গত এটিই হতে চলেছে প্রথম কোনও বড় প্রকল্প। সম্প্রতি প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ১০১টি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তবে তার ফলে, এই প্রকল্পের ওপর কোনও প্রভাব পড়বে না বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
কী এই এআইপি? এই সাবমেরিনে কতটা উপকৃত হবে ভারত ?
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমাগত চিন নিজের উপস্থিতি বাড়িয়ে চলেছে। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করার চেষ্টা চালাচ্ছে চিন। লক্ষ্য, ভারতকে ঘিরে থাকা। এরজন্য ওই এলাকায় হামেশাই চিনা সাবমেরিনের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, পশ্চিমে আরবসাগর হয়ে পাকিস্তানেও ঘাঁটি গেড়েছে চিন। সকলেই জানে যে চিন হল পাকিস্তানের সব মরশুমের বন্ধু। চিনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারতের সামনে সমুদ্রপথে সমস্যার সৃষ্টি করছে পাকিস্তান।
এমতাবস্থায় ভারতের কাছে এখন নৌবাহিনীর বহর বাড়ানো বিশেষ করে রণতরী ও সাবমেরিনের সংখ্যা বৃদ্ধি করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে। অন্তত এমনটাই বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। সীমান্তে চিনের আগ্রাসী মনোভাব ভারতকে ভাবতে বাধ্য করেছে। ড্রাগনের দেশ ও তার শরিকের মোকাবিলা করতে তাই দীর্ঘদিন ধরে ফাঁসে আটকে থাকা এই প্রকল্পকে দ্রুত বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্র। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর ওপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে পরবর্তী "পি-৭৬" শুরু করার ভাবনা রয়েছে কেন্দ্রের।
নৌসেনার প্রাক্তন কর্তারাও মেনে নিয়েছেন সেই কথা। নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ভাইস অ্যাডমিরাল বিমলেন্দু গুহ জানিয়েছেন, পি-৭৫আই এর ফলে, নৌসেনার শক্তি অনেকটাই বৃদ্ধি হবে। কারণ, এই সাবমেরিনগুলিতে আধুনিক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তিনি বলেন, এই সাবমেরিনে এআইপি (এয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রোপালসান) সিস্টেম থাকবে। যা সাবমেরিনের কার্যক্ষমতা অনেকটাই বৃদ্ধি করবে। দীর্ঘদিন জলের তলায় টিকে থাকতে সক্ষম হবে নতুন সাবমেরিন, যা প্রচলিত ডিজেল-চালিত সাবমেরিনের ক্ষেত্রে দারুণ উপযোগী।
কী এই এআইপি?
বর্তমানে প্রচলিত ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিনগুলিকে চালিকা শক্তি জোগায় ফুয়েল সেল ব্যাটারি। অর্থাৎ, জলের তলায় পুরো সিস্টেম চলে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনে, যাকে শক্তি জোগায় ব্যাটারি। কিন্তু, সেক্ষেত্রে একটি সাবমেরিন বড়জোর ৪-৫ দিন পর্যন্ত একটানা জলের নীচে থাকতে পারে। এরপরই তাকে ব্যাটারি রিচার্জ করার জন্য ওপরে উঠতে হয়। সামরিক পরিভাষায় "সারফেসিং বা স্নরকেলিং"। সেই সময় ডিজেল ইঞ্জিন চালিয়ে ব্যাটারি রিচার্জ করতে হয়। ডিজেল ইঞ্জিন চালানোর জন্যই ওপরে উঠতে হয়। কিন্তু, এআইপি সিস্টেমে নিজস্ব বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন করে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনকে চালিকা-শক্তি দেয়। একইসঙ্গে, ফুয়েল সেলকেও রিচার্জ করতে সক্ষম এআইপি। এর দৌলতে একটানা তিন সপ্তাহ জলের তলায় থাকতে পারে সাবমেরিন। এতে সাবমেরিনের কার্যক্ষমতা বাড়ে।
এই সাবমেরিনে ভারত কতটা উপকৃত হবে?
অনেক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিনের তুলনায় আধুনিক প্রযুক্তির ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন বহুক্ষেত্রে অনেক বেশি স্টেলথ প্রমাণিত হয়। শত্রুর রেডারে তাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কারণ ব্যাখ্যা করে তাঁরা জানিয়েছেন, পারমাণবিক সাবমেরিনের রিয়্যাক্টরকে ঠান্ডা রাখতে নিরন্তর কুল্যান্ট পাম্প চালাতে হয়। এর ফলে, একটা নয়েজ (শব্দ) তৈরি হয়। সোনারে অনেক সময় ধরা পড়ে। কিন্তু, এআইপি-চালিত সাবমেরিন একেবারে নিঃশব্দে চলতে পারে।
ফলে, যুদ্ধের সময় পরমাণু সাবমেরিনের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে এই অত্যাধুনিক, এআইপি শক্তিচালিত প্রচলিত অ্যাটাক সাবমেরিন। এছাড়া, তারা ক্ষিপ্র হয়। দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্যত্র যেতে পারে। শত্রুর কাছে এই সাবমেরিন বেশি বিপজ্জনক। অতর্কিত হামলা চালানোর উদ্দেশ্যেই এই সাবমেরিন পারদর্শী।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মূলত অ্যাটাক সাবমেরিন হবে পি-৭৫আই প্রকল্পে তৈরি সবকটি সাবমেরিন। এর মাধ্যমে নজরদারি, তথ্য জোগাড়, সাবমেরিন ও জাহাজ বিধ্বংসী (এএসডব্লিউ), সমুদ্রতল থেকে ভূমিতে হামলা (এএসইউডব্লিউ) ও মাইন পাতার মতো অভিযানে ব্যবহার করবে নৌসেনা। এখানে টর্পেডো ছাড়াও থাকবে জাহাজ ও সাবমেরিন বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, সাবমেরিন থেকে ভূমিতে আঘাত করতে পারা ক্ষেপণাস্ত্র।