APJ Abdul Kalam: বিমান চালানোর স্বপ্নে ধাক্কা! পরে তিনিই হয়ে ওঠেন ভারতের 'মিসাইল ম্যান'
World Students' Day: বিজ্ঞান,গবেষণা এবং পড়াশোনার জগতে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য ২০১০ সাল থেকে এপিজে আবদুল কালামের জন্মদিনটিকে পালন করা হয় World Students' Day হিসেবে।
কলকাতা: দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু (Tamilnadu) রাজ্যের একেবারে দক্ষিণে পাম্বান দীপ। সেখানেই একটি শহর রামেশ্বরম (Ramwswaram)। ওই শহরেরই বাসিন্দা একটি পরিবার- বাবা-মা আর তাদের বেশ কয়েকজন সন্তান। অতি-সাধারণ, দরিদ্র এই পরিবারেরই এক ছেলেকে পরে চিনেছে সারা বিশ্ব। পেশাগত পরিচয় পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভারতবাসীর অত্যন্ত প্রিয় এক মানুষ। তিনি ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং 'মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া' ড. এপিজে আবদুল কালাম।
১৯৩১ সালে আজকের দিনেই জন্ম হয়েছিল ড. এপিজে আবদুল কালামের (APJ Abdul Kalam Birth Anniversary)। রামেশ্বরমে বাবা জয়নুল আবেদিন এবং মা আশিয়াম্মার পরিবারে জন্ম। নৌকাচালক জয়নুল একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে নিয়ম করে মসজিদে যেতেন আবদুল কালাম। সেই স্মৃতির কথা উঠে এসেছে তাঁৎ আত্মজীবনী Wings of Fire-এ। ওই বইতেই কালাম স্মৃতিচারণ করছেন, তাঁর বাবা-মায়ের শিক্ষার কথা। জীবনের প্রতি পরতে এই বিজ্ঞানীর উপর প্রভাব ছিল তাঁর বাবা-মায়ের।
মানবতাই ধর্ম:
রামেশ্বরম মন্দিরের জন্য বিখ্য়াত। সারা বিশ্ব থেকে বহু দর্শনার্থী আসেন ওই শহরে। অন্যতম হিন্দু তীর্থস্থানের কাছেই মসজিদ স্ট্রিটে বাড়ি ছিল তাদের। তাই ছোট থেকেই ভিন্ন সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখেছেন তিনি। আর সারাজীবনই সেই বার্তাই প্রচার করেছেন। Wings of Fire-এ কালাম তুলে ধরেছেন তাঁর ছোটবেলার একটি স্মৃতির কথা। তাঁর বাবা এবং রামেশ্বরম মন্দিরের পূজারি পক্ষী লক্ষ্ণণ শাস্ত্রী অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন। কালাম লিখছেন, 'ছোটবেলার স্মৃতিগুলির মধ্যে অন্যতম এই দুজন মানুষের কথা। দুজনেই তাদের সাবেকি পোশাকে থাকতেন। প্রায়শই বসে গল্প করতেন, তাদের কথার মধ্যে অধিকাংশই আধ্যাত্মিক কথা থাকত।' প্রার্থনা করলে কী হয়? একবার নাকি এই প্রশ্নই বাবাকে করেছিলেন কালাম। উত্তরে কী বলেছিলেন তাঁর বাবা? কোনওরকম তর্জমা না করে কালামের লেখনীতে, 'When you pray, you transcend your body and become a part of the cosmos, which have no division of wealth, age, caste or creed.'
আরও একটি অভিজ্ঞতার কথা রয়েছে তাঁর আত্মজীবনীতে। রামেশ্বর এলিমেন্টারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক শিক্ষক এসেছিলেন সেই স্কুলে। কালাম এবং তাঁর বন্ধু রামানাধা শাস্ত্রী পাশাপাশি বসতেন। কিন্তু তা না পসন্দ ছিল ওই শিক্ষকের। ভিন ধর্ম হওয়ার কারণে পিছনের সারিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কালামকে। সেই ঘটনার কথা কালাম এসে বাবা-মাকে বলেছিলেন। আর অন্যদিকে রামানাধা বাড়ি গিয়ে নালিশ করেছিল তাঁর বাবা লক্ষ্ণণ শাস্ত্রীকে, যিনি রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। তা শুনেই সেই শিক্ষককে ডেকে পাঠিয়েছিলেন লক্ষ্ণণ শাস্ত্রী। কার্যত তিরস্কার করে ওই শিক্ষককে বলা হয়েছিল ছোটদের মধ্যে ভেদাভেদের বিষ না ছড়াতে। ক্ষমা চেয়েছিলেন ওই শিক্ষক। লক্ষ্মণ শাস্ত্রীর এই শিক্ষার প্রভাব হয়তো সারাজীবনের মতো রয়েছিল এপিজে আবদুল কালামের মনে।
ছোট্টবেলার রোজগার:
ছোটবেলায় নানা ধরনের কাজ করেছেন এপিজে আবদুল কালাম, সেই বিবরণ উঠে এসেছে তাঁর আত্মজীবনীতে। ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখন কালামের বয়স বছর আট। সেই সময় হঠাৎ তেঁতুল বীজের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল। তখন তিনি সারাদিন ঘুরে তেঁতুল বীজ বিক্রি করে দোকানে বিক্রি করতেন তিনি। খবরের কাগজ বিক্রির কাজও করেছেন তিনি।
রামেশ্বরম ছেড়ে যাওয়া:
ভারতের স্বাধীনতা তখন আসন্ন। সেইসময় নিজের জীবনেও বড়সড় পদক্ষেপ করেন এপিজে আবদুল কালাম। রামেশ্বরম ছেড়ে জেলাসদরে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কালাম। সেই সিদ্ধান্তকে সাদরে স্বাগত জানিয়েছিলেন তাঁর বাবা। এমনকী, কালামের মা আশিয়াম্মাকেও বুঝিয়েছিলেন তিনিই। ভিন শহরে পড়তে গিয়ে মন খারাপ হতো তাঁর। তবুও বাবার স্বপ্ন সফল করতেই জেদ ধরে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু জন্মভূমি থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া নিয়ে তাঁর খেদ ছিলই। আত্মজীবনীতে তিনি লিখছেন, 'আমার নিয়তি আমায় রামেশ্বরম নিয়ে যায়নি। বরং আমার ছোটবেলার ঘর থেকে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে।' রামানাথাপুরমে পড়াশোনার সময়ে- জীবনের এই অধ্যায়ে কালামের জীবনে প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁর এক শিক্ষক ইয়াদুরাই সলোমন।
স্কুল জীবন শেষ করে সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি নেন কালাম। তারপর তিনি বোঝেন যে পদার্থবিদ্যা নয়, ইঞ্জিনিয়ারিং তাঁর আসল ইচ্ছে। ভর্তি হন মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে। কিন্তু বাদ সাধে আর্থিক অবস্থা। প্রয়োজন ছিল ১ হাজার টাকার। কিন্তু তাঁর বাবার সেই অর্থ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তখন ভাইয়ের পাশে দাঁড়ান তাঁর বোন জোহরা। নিজের গয়না বন্ধক দিয়ে কালামের হাতে ভর্তির টাকা তুলে দেন তিনি।
বিমান ওড়ানোর স্বপ্ন:
মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির (Madras Institute of Technology) ক্যাম্পাসের সামনে ২টি বিমান রাখা ছিল। সেটা দেখেই স্বপ্ন দেখেছিলেন কালাম। বিমানচালক হওয়ার লক্ষ্যেই স্পেশাল ব্রাঞ্চ নিয়েছিলেন অ্য়ারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।
চাকরিজীবন শুরু HAL-এ:
মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে পাশ করে বেরনোর পরে ট্রেনি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন Hindustan Aeronautics Limited-এ। বিমানবাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু, ইন্টারভিউ বোর্ডে ব্যর্থ হন। আত্মজীবনীতে তিনি লিখছেন যে, তিনি প্রবল আশাহত হয়েছিলেন, মুষড়ে পড়েছিলেন। সেই সময়েই তাঁর সাক্ষাৎ হয় স্বামী শিবানন্দ-এর সঙ্গে। তাঁর পরামর্শেই ফের ফিরে পান মনের জোর। নিয়তিকে মেনে এগিয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বামী শিবানন্দ। তারপর থেকে শুধুই উত্থান।
DRDO...ISRO--মিসাইল ম্যান:
১৯৬০ সালে DRDO-তে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মজীবন শুরু কালামের। তারপর ১৯৬৯ সালে তাঁকে নিয়ে আসা হয় ISRO-তে। ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিক্যাল তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। PSLZ, SLV-III প্রকল্পেও তাঁর অবদান রয়েছে।
আজ ভারতের যে সামরিক শক্তি, তার অনেকটাই নির্ভরশীল ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভারের উপর। এই ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভারের অনেকটাই এপিজে আবদুল কালামের অবদান। সেই কারণেই তাঁর আরেক পরিচয়- 'মিসাইল ম্যান'। ভারতের তৈরি প্রথম ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল অগ্নি- লঞ্চ হয় ১৯৮৯ সালে। অগ্নি এবং ভূমি থেকে ভূমি পৃথ্বী মিসাইল তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁর।
সমাজের চিন্তা:
সাধারণ ভারতীয় নাগরিকরা যাতে স্বল্পমূল্যে ভাল চিকিৎসা পরিষেবা পান, তা ভাবনায় ছিল এপিজে আবদুল কালামের। সেই লক্ষ্যে কাজও করেছেন। ১৯৯৮ সালে চিকিৎসক সোমা রাজুর সঙ্গে মিলে তৈরি করেন স্বল্পমূল্যের করোনারি স্টেন্ট। ২০১২ সালে এই দুজনেই তৈরি করেছিলেন ট্যাবলেট কম্পিউটার- যা গ্রামীণ এলাকায় সহজে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করার লক্ষ্য ছিল।
অজস্র পুরস্কার:
একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এপিজে আবদুল কালাম। ১৯৮১ সালে পদ্মভূষণ, ১৯৯০ সালে পদ্মবিভূষণ পান তিনি। এরপরে ১৯৯৭ সালে ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন (Bharat Ratna) উপাধিতে ভূষিত করা হয় এই বিজ্ঞানীকে।
রাষ্ট্রপতি পদে:
২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি (President Of India) হিসেবে দায়িত্বপালনও করেছেন এপিজে আবদুল কালাম।
অবসরের পরে এবং রাষ্ট্রপতির দায়িত্বের মেয়াদ ফুরনোর পরে শিক্ষকতাতেই নিজেকে সপে দিয়েছিলেন তিনি। ভারতের প্রথম সারির একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নিতেন, আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করতেন। পছন্দ করতে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে। যে মানুষটি শিক্ষকতা-পড়াশোনাকে এত ভালবেসেছিলেন। তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্তও সেই মঞ্চেই কেটেছিল। শিলংয়ে IIM-এর একটি আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে রাখতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। দিনটি ছিল ২৭ জুলাই, ২০১৫। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর জন্মস্থান রামেশ্বরমে তাঁর অন্তিম ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল।
বিজ্ঞান,গবেষণা এবং পড়াশোনার জগতে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য ২০১০ সাল থেকে এপিজে আবদুল কালামের জন্মদিনটিকে পালন করা হয় World Students' Day হিসেবে।
ঋণ: Wings of fire
আরও পড়ুন: ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে সোজা 'নায়ক'! কুমুদলাল হয়ে উঠলেন 'হার্টথ্রব' অশোককুমার