মন্দির – অপার্থিব জগতের এক প্রবেশদ্বার
সদগুরু: মানুষের অনুভূতি বা অভিজ্ঞতার প্রকৃতিটা এমনই যে, এই মুহূর্তে সে যা কিছুর সঙ্গে যুক্ত, তার অভিজ্ঞতায় সেটাই হবে একমাত্র সত্য। এই মুহূর্তে, বেশিরভাগ মানুষ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সব কিছু উপলব্ধি করছেন আর তাঁরা সেটাকেই একমাত্র সত্য মনে করেন এবং মনে করেন এর বাইরে আর কিছু নেই। যা ভৌত কেবল তাকেই ইন্দ্রিয়গুলি অনুভব করতে পারে এবং যেহেতু আপনার উপলব্ধি পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সীমাবদ্ধ, তাই আপনি জীবন হিসাবে যা জানেন তাও কেবল ভৌত — আপনার শরীর, আপনার মন, আপনার আবেগ এবং আপনার জীবনীশক্তি, এগুলিও ভৌত। আপনি যদি এই ভৌত অস্তিত্বকে একটা চাদর হিসাবে বা এক টুকরো কাপড় হিসাবে দেখেন... ধরা যাক, আপনি এই ভৌত জগতের কাপড়টির ওপরে আছেন। আপনি এই কাপড়ের টুকরোটির ওপর হাঁটছেন আর আপনি যার ওপরে হাঁটছেন, আপনার কাছে জগত বলতে শুধু সেটাই। কিন্তু যখন আপনি উপর দিকে তাকান, সেখানে মনে হয় যেন এক অসীম শূন্যতা রয়েছে এবং এমনকি সেখানেও আপনি কেবলমাত্র ভৌত বস্তুগুলিকেই চিনতে পারেন, আপনি যে তারা বা সূর্য বা চাঁদকে দেখেন, এ-সবই ভৌত। যা ভৌত নয় তাকে আপনি দেখতে বা উপলব্ধি করতে পারেন না।
আপনি যাকে মন্দির বলেন তা এই চাদর বা কাপড়ের টুকরোটিতে একটা ফুটো করার মতো, অর্থাৎ এমন একটা স্থান তৈরি করা যেখানে ভৌত স্তরটি ক্ষীণ বা পাতলা হয়ে যায় এবং ভৌত স্তরটির বাইরের কিছু আপনার কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ভৌত জগতের প্রকাশকে ফিকে করে দেওয়ার এই বিজ্ঞানটিই হল কনসেক্রেসন বা প্রাণ-প্রতিষ্ঠার বিজ্ঞান, যার মাধ্যমে, আপনি ইচ্ছুক থাকলে ভৌত জগতের বাইরের সেই মাত্রাটি আপনার কাছে স্পষ্ট বা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এই উপমাটিকে আরও সঠিকভাবে তুলে ধরতে গেলে বলা যায়, মন্দির হল যেন ভৌত জগতের চাদরে একটি ফুটোর মতো, যার মধ্যে দিয়ে সহজেই আপনি গলে গিয়ে ভৌত জগতের বাইরে যেতে পারেন।
এখনকার মন্দিরগুলোকে হয়তো একেবারে ঠিক শপিং কমপ্লেক্সের মতো করে তৈরি করা হয়— কংক্রিট, ইস্পাত আর সব কিছু দিয়ে,...এবং সম্ভবত একই উদ্দেশ্যেও, কারণ সব কিছুই ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমি যখন মন্দিরের কথা বলি, তখন আমি প্রাচীন মন্দিরগুলি যেভাবে তৈরি হয়েছিল তার কথা বলছি। এদেশে প্রাচীনকালে মন্দির শুধু শিবের জন্যই নির্মিত হত, অন্য কারও জন্য নয়। শুধু পরের দিকেই অন্যান্য মন্দিরগুলি গড়ে উঠেছিল কারণ মানুষজন তাৎক্ষণিক কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করতে শুরু করেছিলেন। এই বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে তাঁরা অন্যান্য বিভিন্ন আকৃতি তৈরি করতে শুরু করেছিলেন যাতে স্বাস্থ্য, সম্পদ, কল্যাণ এবং আরও অনেক কিছুর ক্ষেত্রে, নিজেদের বিভিন্ন উপকারে তাঁরা তাদের কাজে লাগাতে পারেন। তাঁরা নানা ধরণের শক্তি এবং নানা ধরণের দেব-দেবী সৃষ্টি করেছিলেন। যদি অর্থ চান, আপনি এক ধরণের আকৃতি তৈরি করেন, যা সেই ধরণের কিছুকে সহায়তা করবে, বা আপনি ভয়-ভীত থাকলে অন্য ধরণের আকৃতি তৈরি করেন। এই মন্দিরগুলি গত ১১০০-১২০০ বছরে গড়ে উঠেছে কিন্তু তার আগে, শিব মন্দির ছাড়া দেশে আর কোনও মন্দির ছিল না।
‘শিব’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল ‘যা কোনও কিছুই নয়'। তাই মন্দির তৈরি করা হয়েছিল ‘যা কোনও কিছুই নয়’ তাঁর জন্য। 'যা কোনও কিছু' তা হল ভৌত প্রকাশ; 'যা কোনও কিছুই নয়' তা ভৌত জগতের উর্দ্ধে। সুতরাং মন্দির হল একটা ছিদ্র বা গর্ত যার মধ্য দিয়ে আপনি এমন একটি স্থানের মধ্যে প্রবেশ করেন যা 'শূণ্য বা ফাঁকা বা কোনও কিছুই নয়'। এই দেশে হাজার হাজার শিব মন্দির রয়েছে এবং তাদের বেশিরভাগেই তেমন কোনও মূর্তি নেই। তাদের মধ্যে কেবল একটি 'প্রতীকী রূপ বা মূর্তি' থাকে এবং সাধারণত সেটি হয় একটি লিঙ্গ। 'লিঙ্গ' শব্দের অর্থ হল 'পরম আকৃতি'। আমরা একে পরম আকৃতি বলছি কারণ যখন অপ্রকট নিজেকে প্রকট করতে শুরু করেছিল, বা অন্যভাবে বললে যখন সৃষ্টি জন্ম নিতে শুরু করেছিল, তখন প্রথম যে রূপটি গ্রহণ করেছিল তা ছিল একটি উপগোলক। একটি নিখুঁত উপগোলককেই আমরা লিঙ্গ বলে থাকি। আজকে আধুনিক মহাকাশ-বিজ্ঞানীরাও সেটা নানাভাবে চিনতে শুরু করেছেন।
একটি বিষয় হল, প্রতিটি গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের কেন্দ্রের অন্তঃস্থলটি সব সময়ই উপগোলক হয়। অর্থাৎ, এটি সর্বদাই একটি উপগোলক বা একটি লিঙ্গ হিসাবেই শুরু হয়েছিল, এবং তার পরে অন্যান্য নানান জিনিসে পরিণত হয় এবং আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, আপনি যদি ধ্যানের গভীর অবস্থায় যান, চূড়ান্ত লয় বা বিলীন হওয়ার একটি অবস্থায় আসার আগে, শক্তি আবারও একটি উপগোলক বা একটি লিঙ্গের আকার নেয়।
অর্থাৎ প্রথম আকারটি হল লিঙ্গ এবং চূড়ান্ত আকারটি হল লিঙ্গ, মাঝে যা রয়েছে তা হল জগৎ এবং এই সবের বাইরে যা আছে তা হল শিব। অর্থাৎ লিঙ্গের আকারটি হল সৃষ্টির এই চাদরে একটি ছিদ্রের ন্যায়। যেন গোটা ভৌত সৃষ্টিটি একটা ঘর যার পিছনের দরজাটি হল লিঙ্গ, সামনের দরজাটি হল লিঙ্গ। তাই এই কারণেই আমি কোনও মন্দিরকে একটি ছিদ্র হিসাবে উল্লেখ করছি যার মধ্য দিয়ে আপনি গলে গিয়ে ভৌত জগতের বাইরে পড়তে পারেন; এটাই মন্দিরের মূলতত্ত্ব।
সদগুরু একজন যোগী, অতীন্দ্রিয়বাদী এবং নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলিং লেখক। ভারতবর্ষের প্রথম ৫০ জন প্রভাবশালী মানুষদের মধ্যে একজন ধরা হয়। ২০১৭ সালে ভারত সরকার সর্বোচ্চ বার্ষিক বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণে ভূষিত করেছে সদগুরুকে, যা ব্যতিক্রমী এবং বিশিষ্ট সেবার জন্য প্রদত্ত। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম গণআন্দোলন, কনশাস প্ল্যানেট – সেভ সয়েল-এর প্রতিষ্ঠাতা, যা ৩৯০ কোটিরও বেশি মানুষকে স্পর্শ করেছে।
বি : দ্র : প্রতিবেদনটি এবিপি লাইভ কর্তৃক সম্পাদিত নয়