ABP Exclusive: কোহলি-গেলদের খেলে যাওয়া মাঠে নেশার আসর! কাঠগড়ায় ফের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Jadavpur University Exclusive: ইডেনে আন্তর্জাতিক ম্যাচের সময় অন্য দেশের তারকা ক্রিকেটারেরাও প্র্যাক্টিস করেন এই মাঠে। যে তালিকায় রয়েছে বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন, ক্রিস গেলের মতো মহাতারকাদের নামও!
সন্দীপ সরকার, কলকাতা: রোজ সকালে একই দৃশ্য। কোথাও পড়ে মদের বোতল। কোথাও ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। কোথাও কন্ডোম। দেখে বোঝা দায়, এটা ক্রিকেট মাঠের ছবি, নাকি নাইট পার্টির পরের সকালে কোনও ক্লাবের!
শুনলে অনেকের চোখ বিস্ফারিত হতে পারে। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে ফেলতে পারেন, এই দৃশ্য ক্রিকেট মাঠের? এ-ও কি সম্ভব? কিন্তু এরকম অরাজকতার অভিযোগই শোনা যাচ্ছে সিএবি-র অন্দরমহলে।
অভিযোগ, ক্রিকেট মাঠের এই মাৎস্যন্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (Jadavpur University) পড়ুয়াদের একাংশ! কারণ, ঘটনাস্থল সল্ট লেকের চিংড়িহাটায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (JU) দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। যেখানে সিএবি (CAB) পরিচালিত একটি ক্রিকেট মাঠ রয়েছে। রয়েছে সংলগ্ন ড্রেসিংরুম, ক্যান্টিন। এই মাঠে স্থানীয় ক্রিকেটের খেলা হয়। শুধু সিনিয়র ক্রিকেটারেরাই নয়, বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলের খেলোয়াড়েরাও ম্যাচ খেলে এই মাঠে।
সবচেয়ে বড় কথা, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (BCCI) ম্যাচ হয়। ইডেনে (Eden Gardens) আন্তর্জাতিক ম্যাচের সময় অন্য দেশের তারকা ক্রিকেটারেরাও প্র্যাক্টিস করেন এই মাঠে। যে তালিকায় রয়েছে কেন উইলিয়ামসন (Kane Williamson), ক্রিস গেলের (Chris Gayle) মতো মহাতারকাদের নামও! ভিশন ২০২০ শিবিরে মুথাইয়া মুরলীধরন থেকে শুরু করে ওয়াকার ইউনিস, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ভি ভি এস লক্ষ্মণ, কিংবদন্তি ক্রিকেটারেরা এই মাঠে এসে তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। দিল্লি ক্যাপিটালসের ক্রিকেটারদের নিয়ে এই মাঠে প্রস্তুতি শিবির করেন মেন্টর সৌরভ। ২০২২ সালে আইপিএলের প্লে অফ ম্যাচ খেলতে কলকাতায় এসে বিরাট কোহলিদের (Virat Kohli) রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর দল প্র্যাক্টিস করেছিল এই মাঠে। ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলতে কলকাতায় এসে উইলিয়ামসনের নিউজ়িল্যান্ডের প্রস্তুতি শিবিরও হয়েছিল।
পড়ুয়াদের 'কীর্তি'তে আপাতত নাজেহাল দশা সিএবি কর্তা ও কর্মীদের। অভিযোগ, সকালে যে মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ বা প্র্যাক্টিস চলে, সন্ধ্যার পর থেকেই তা চলে যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের দখলে। মাঠের মধ্যেই বসে নেশার আসর। প্রতিবাদ করলে লাভ খুব একটা হয় বলে খবর নেই। বরং মাঠে সিএবি-র তরফে যে জনাদুয়েক নিরাপত্তারক্ষী নৈশপ্রহরায় থাকেন, তাঁদের কার্যত ঢাল নেই, তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দারের অবস্থা। না তাঁদের কথা পড়ুয়াদের কেউ শোনেন, না মানেন।
সবচেয়ে বড় কথা, পরের দিন সকালে ফের ম্যাচ আয়োজন করা রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষা হয়ে ওঠে সিএবি কর্তা ও কর্মীদের কাছে। কারণ, সকাল হলেই মদের বোতল, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ, কন্ডোম কুড়িয়ে মাঠ ও সংলগ্ন এলাকা সাফ করতে হয়। বিশেষ করে মদের ভাঙা বোতলের টুকরো নিয়ে ত্রস্ত থাকতে হয় মাঠকর্মীদের। ভাঙা কাচের টুকরো থেকে ক্রিকেটারেরা চোট পেলে যে তোলপাড় পড়ে যেতে পারে!
২০ বছর আগে মাঠটি ক্রিকেটের জন্য সিএবি-কে দেওয়া হয়েছিল। বাবলু কোলে তখন সিএবি সচিব। মাঠের বাইরের সীমানা প্রাচীরে এখনও জ্বলজ্বল করছে ফলক। যার ওপরে লেখা, ২০০৩ সালের ২০ মার্চ মাঠটি ক্রিকেটের জন্য দেওয়া হল। পরে মাঠ সংলগ্ন ড্রেসিংরুম, ক্যান্টিন নির্মাণ করে সিএবি। জগমোহন ডালমিয়া তখন সিএবি প্রেসিডেন্ট। ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর নবনির্মিত ড্রেসিংরুমের উদ্বোধন করেছিলেন ক্রিস গেল। যিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ক্রিকেট দলের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন। সচিন তেন্ডুলকরের বিদায়ী টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচ খেলবেন বলে।
সিএবির তরফে অভিযোগ করা হচ্ছে, সূর্যাস্তের পরেই মাঠ যেভাবে পড়ুয়াদের দখলে চলে যায়, তা বেশ উদ্বেগজনক। বলা হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চলে মাঠের দুই প্রান্তের সাইটস্ক্রিন লাগোয়া স্ট্যান্ডে। ছাত্র-ছাত্রীরা রীতিমতো স্ট্যান্ডের ওপরে উঠে নেশার আসর বসান। বারণ করলে বলা হয়, এই মাঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের। সিএবি-র একজন বলছিলেন, 'মাঝে মধ্যে গোটা মাঠে নেশার আসর বসে। মাঠে কোনও বড় আলো নেই। বোর্ড ম্যাচ চলাকালীন এরকম পরিস্থিতি চললে তো আমরা প্রার্থনা করি, যেন সব কিছু হাতের বাইরে না চলে যায়। এছাড়া ম্যাচ চলাকালীন পাশের ফুটবল মাঠ থেকে বল উড়ে এসে খেলার বিঘ্ন ঘটার মতো পরিস্থিতি তো হামেশাই ঘটে। বারণ করলে পড়ুয়াদের কেউই পাত্তা দেন না।'
বেশ কিছু ঘটনার কথা সিএবি-তে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ হচ্ছে, অন্ধকারের ফায়দা তুলে মাঠ সংলগ্ন এলাকায় উদ্দামতা চলে। এমনকী অভিযোগ, শারীরিক সম্পর্কও চলে অবাধে। মাঠ ও সংলগ্ন এলাকায় কোনও বড় বাতিস্তম্ভ নেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পর সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো নিয়ে তোলপাড় চলছে। তীব্র সমালোচনা, আন্দোলনের পর মূল ক্যাম্পাসের একাধিক জায়গায় বসছে সিসিটিভি। কিন্তু চিংড়িহাটা ক্যম্পাসের ক্রিকেট মাঠ ও সংলগ্ন এলাকায় সেসবের নামগন্ধ নেই। সিসিটিভি বসানো ও উজ্জ্বল আলো লাগানোর দাবি অনেকদিনের। যদিও তা এখনও মানা হয়নি।
এই পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়নি? সিএবি প্রেসিডেন্ট স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের দফতরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, হয়েছে। সিএবি থেকে বেশ কয়েকবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ঘটনার কথা জানানো হয়েছে।
যদিও তাতে পরিচিত ছবি খুব একটা বদলায়নি বলেই অভিযোগ। সিএবি সূত্রে খবর, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পর রাজ্যজুড়ে যখন হুলস্থূল চলছে, 'তাণ্ডব' কিছুটা কমেছে। তবে বঙ্গ ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থার আশঙ্কা, পরিস্থিতি থিতিয়ে গেলেই ফের শুরু হবে পড়ুয়াদের 'দৌরাত্ম্য'। আপাতত পাকাপাকি সমাধানের অপেক্ষায় সিএবি।
যাদবপুরের মূল ক্যাম্পাসে বেনিয়ম ঠেকাতে যেখানে নানারকম পদক্ষেপ করা হচ্ছে, সেখানে চিংড়িহাটা মাঠের অব্যবস্থা দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী ভাবছে? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এই মাঠের দায়িত্বে রয়েছেন প্রণব গায়েন। তাঁকে এবিপি লাইভের তরফে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। গোটা বিষয়টি হোয়াটসঅ্যাপে জানানো হলেও তিনি জবাব দেননি।
সিএবি থেকে ভবিষ্যতে এই মাঠে ফ্লাডলাইট বসানো, জিম-জাকুজির মতো পরিকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। সামনেই ভারতের মাটিতে ওয়ান ডে বিশ্বকাপ। ইডেন গার্ডেন্সে একটি সেমিফাইনাল-সহ পাঁচটি ম্যাচ রয়েছে। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এক সপ্তাহের প্রস্তুতি শিবির হতে পারে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্ট লেক ক্যাম্পাসে।
তার আগে পড়ুয়াদের 'দৌরাত্ম্য' রুখতে কি পদক্ষেপ করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ? আপাতত এই প্রশ্নের সদুত্তরের অপেক্ষায় সিএবি ও বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীরা।
আরও পড়ুন: সময়মতো হয়নি নির্বাচন, নির্বাসিত হল ভারতীয় কুস্তি সংস্থা