New Show Update: মেহফিল জমাতে ডাক পড়ত, মহাপুরুষদেরও কাঁদিয়ে ছাড়তেন, বিস্মৃত 'বাঈজি সঙ্গীত' ফিরছে শহরে
'Baiji Sangeet': অ্যাকাডেমি থিয়েটারের নিবেদন 'বাঈজি সঙ্গীত'। মূল ভাবনা ও অনুষ্ঠান পরিচালনায় ঋদ্ধি বন্দোপাধ্যায় ও দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
কলকাতা: অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনবিংশ শতকের শুরুতে কলকাতা শহরে জমিদার থেকে শুরু করে উঠতি ধনীদের যে দাপট শুরু হয়, তারই ফলস্বরূপ এসেছিল 'বাবু কালচার' (Babu Culture)। আর এই বাবুদের উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতা শহর পরিচিত হয়ে ওঠে আরও একটি শব্দের সঙ্গে, তা হল 'বাঈজি' (Baiji)। অ্যাকাডেমি থিয়েটারের (Academy Theatre) নিবেদন 'বাঈজি সঙ্গীত'-এর (Baiji Sangeet) মূল বিষয় সেই সময়ের এই নৃত্য পটিয়সী রমণীরা।
অ্যাকাডেমি থিয়েটারের নিবেদন 'বাঈজি সঙ্গীত'
মধ্যযুগের শুরু থেকেই রাজ দরবারে নৃত্য ও গীতে পারদর্শী রমণীদের বিশেষ স্থান ছিল। বিশেষত তাঁরাই বাঈজি নামে পরিচিত ছিলেন। কলকাতা শহরে বাবুদের বিনোদনের ক্ষেত্রে যখন তাঁরা সমাজচিত্রে দেখা দিলেন, তখন তাঁদের শৈল্পিক পারদর্শিতার সঙ্গে অচিরে যোগ হয়ে গেল 'দেহ পসারিনি'র তকমা। বলা হয়, কোনও 'অপরাধ'-এ স্বর্গের অপ্সরারা অভিশপ্ত হয়ে নরলোকে জন্মগ্রহণ করতেন এবং কলকাতায় আসর জাঁকিয়ে বসতেন। সে ইতিহাস অন্তত একশো বছরের পুরনো। হাতিবাগান থেকে বিডন স্ট্রিট পর্যন্ত অঞ্চল নটীর নুপূর নিক্কনে মুখরিত হয়ে উঠত, মদ্যপ শ্রোতারা বারবার এনকোর এবং করতালির সমবেত শব্দে থিয়েটারের করিন্থিয়ান থামগুলিতে কম্পন ধরাত।
বাঈজিদের সমাজে যে কখনওই শ্রদ্ধার আসনে বসানো হয়নি, তা উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকে তাঁদের নিয়ে যে সমস্ত লেখালেখি হয়েছিল তাতেই একেবারে পরিষ্কার। একবার নাকি তেমনই এক বাঈজির গানে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং বিবেকানন্দ। শহরের বাঈজিদের নিয়ে আলোচনা করলে অবশ্যই আসে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথের কথাও। বৌবাজারে দ্বারকানাথ ঠাকুরের দুটো কোঠা ছিল। যেখানে ৪৩টি ঘর জুড়ে ছিল যৌনকর্মীদের আস্তানা।
গ্রাম, আধা শহর থেকে রুজিরোজগার করতে কলকাতার নাটকের হাটে নিজেদের নিকষিত হেম যৌবন মেলে ধরতেন তাঁরা। উনিশ শতকের প্রথম দিকেই কলকাতার নবীনা নাগরিকারা নাচগানের পসরা খুলে বসল, ক্রেতাও জুটল যথেষ্ট। তার আগে এ শহরে যাত্রাওয়ালিরাও মেয়ে যাত্রার দল খুলে বসেছিল। এমন বিবিধ গল্প, বিবিধ বিষয় নিয়ে অ্যাকাডেমি থিয়েটারের এবারের নিবেদন 'বাঈজি সংগীত'। মূল ভাবনা ও অনুষ্ঠান পরিচালনায় ঋদ্ধি বন্দোপাধ্যায় ও দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনা করবেন অভিনেত্রী দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে উচ্ছ্বসিত তিনি। বলেন, 'আমি যখন প্রথম এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম তখন শুধু নৃত্যশিল্পী হিসেবেই যুক্ত হয়েছিলাম। বিষয়টি সম্পর্কে গভীরভাবে অবগত ছিলাম না। কিন্তু যখন দেবজিতদার থেকে এই বিষয়ের গভীরতা সম্পর্কে ধীরে ধীরে জানতে পারলাম, সত্যি বলতে আমি আপ্লুত হয়ে গিয়েছি। আমার মনে হয় মানুষ দীর্ঘদিন এই অনুষ্ঠান মনে রাখবেন।'
অনুষ্ঠানের ভাষ্যপাঠে রয়েছেন আরও এক অভিনেতা দেবদূত ঘোষ। তাঁর কথায়, 'দেবজিতদা ও ঋদ্ধিদির সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। দেবজিতদার কাজ, তাঁর লেখনী আমার বিশেষ প্রিয়, সেই সম্পর্কের সূত্রেই কাজ করতে আসা। কিন্তু এসে যখন বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হলাম, আমার মনে হয়েছিল, এরকম কাজ আগে কেন হল না! এই কাজ ভীষণ প্রয়োজনীয়। মানুষ এই অনুষ্ঠান দেখলে, সংস্কৃতির এক এমন আঙ্গিকের সঙ্গে অবগত হবেন, যা আমাদের নগর জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।'
এই বিষয়ে অনুষ্ঠানের মূল পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পী, লেখক দেবজিত বন্দোপাধ্যায় বলেন, 'আমাদের দেশে বাঈজি সংস্কৃতি সেই আদি যুগ থেকেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তাঁদের নাচ, গান ও মনোরঞ্জন করার যে ক্ষমতা, তাতেই আমরা চিরকাল মোহিত হয়ে থেকেছি। কিন্তু তার পাশাপাশি আমাদের এটা বোঝা দরকার, তাঁরা এমন একটা সংস্কৃতির ধারাকে অব্যাহত রেখেছেন যা আজকের সঙ্গীতের বিভিন্ন আঙ্গিককে সমৃদ্ধ করে চলেছে। আজকের এই ডিজিটাল যুগে সেই সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছি আমরা। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত হোক, বা আঞ্চলিক সঙ্গীত, সব ধারাতেই তাঁদের সহজ যাতায়াত ছিল। তাঁদের গান, তাঁদের সাংস্কৃতিক চর্চার বিভিন্ন আঙ্গিককে মানুষের কাছে পরিবেশন করার লক্ষ্যেই আমাদের এই অনুষ্ঠান। আশা করি দর্শক এই পরিবেশনাটি পছন্দ করবেন।'
অন্যদিকে ঋদ্ধি বন্দোপাধ্যায় বলেন, 'আমি প্রধানত পঞ্চকবির গান, নাটকের গান গেয়ে থাকলেও, কলকাতার বাঈজি সঙ্গীত ও বাঈজিদের সাংস্কৃতিক চর্চা আমায় বরাবর ভীষণ আকর্ষণ করে। আমরা যাঁরা মহিলা সঙ্গীতশিল্পী, আমি মনে করি তাঁদের প্রত্যেকের স্বাধীনচেতা পরিবেশনার মাঝে ওঁদের অবদান আছে। আমাদের এই অনুষ্ঠান সেই সমস্ত শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য, যাঁরা নিজেদের পেশাগত পন্থার কারণে যোগ্য সম্মান পাননি বলে আমি মনে করি। আমাদের অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে এই প্রায় ভুলতে বসা শিল্পী ও তাঁদের শিল্পকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে চলেছি।'
২৮ ডিসেম্বর 'জ্ঞান মঞ্চে' সন্ধে ৬টা থেকে অনুষ্ঠিত হবে এই অনুষ্ঠান। পাঠে রয়েছেন প্রখ্যাত অভিনেতা দেবদূত ঘোষ। নৃত্যে অভিনেত্রী দেবযানী চট্টোপাধ্যায়। নৃত্য পরিচালনায় রয়েছেন অভিরূপ সেনগুপ্ত।
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।