এক্সপ্লোর
Advertisement
'প্রান্তিক মানুষের হাতে টাকা যাক, বাড়ুক সরকারি-বেসরকারি লগ্নি'
অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে গেলে যে ছোট এবং মাঝারি কোম্পানিগুলোর দিকেই প্রাথমিকভাবে তাকাতে হবে, এ-নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু ঋণের যোগান বাড়ালেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাগুলোর স্বাস্থ্যোন্নতি ঘটবে কি? লিখছেন অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার
করোনা দুর্যোগের কবল থেকে ভারতীয় অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য বিভিন্ন স্তরে ঋণের যোগান বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারমণ। বস্তুত, তিনি মনে করছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঋণ দিতে পারলে,সুদের হার কমিয়ে সেই ঋণকে অধমর্ণের কাছে যথেষ্ট মাত্রায় আকর্ষণীয় করে তুলতে পারলে, এবং পুরোনো ঋণ শোধ দেবার মেয়াদ খানিকটা বাড়িয়ে দিতে পারলেবর্তমান সংকট মোটামুটি কেটে যাবে। এছাড়া অবশ্য ভারতীয় অর্থনীতির কিছু কাঠামোগত দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও অর্থমন্ত্রীর নজরে এসেছে। সেগুলি মেটানোর জন্য তাঁর সুপারিশ একগুচ্ছ বাজারমুখী স্থায়ী সংস্কার। কিন্তুস্থায়ী সংস্কার তো ভবিষ্যতের কথা। আপাতত যে গহ্বরে অর্থনীতিটা তলিয়ে যাচ্ছে তার থেকে এক্ষুনি উঠে আসা দরকার। এবং উঠে আসার তাৎক্ষণিক দাওয়াই, অর্থমন্ত্রী মনে করছেন, ঋণের যোগান বাড়ানো।
দু’মাস হয়ে গেল দেশটা তালাবন্দি হয়ে রয়েছে। এই দু’মাসে বেশিরভাগ কাজকর্ম বন্ধ। উৎপাদন নেই, পরিষেবা নেই, বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদাগুলো কোনওক্রমে মিটিয়ে মানুষ অতি কষ্টে বেঁচে আছে। আমাদের দেশে সিংহভাগ কর্মসংস্থান হয় ছোট এবং মাঝারি সংস্থাগুলোতে। তালাবন্দির ফলে এদের অধিকাংশই বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এইসব সংস্থার আয়ও বন্ধ। ফলে কর্মচারিরাও নিয়মিত মাইনে পাচ্ছেন না। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য অর্থমন্ত্রী মূলত এই ছোট এবং মাঝারি সংস্থাগুলোর ওপর নজর দিয়েছেন।
ক্ষুদ্র এবং মাঝারি সংস্থাগুলোর প্রায় সকলেরই বাজারে প্রচুর ধার রয়েছে। ঋণ পরিশোধের শর্তগুলো শিথিল না করলে এরা প্রত্যেকেই ঋণখেলাপী হয়ে যেত। তাতে একদিকে যেমন সংস্থাগুলোর অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় দেখা দিত, তেমনি অন্যদিকে ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো,যারা এই ধার দিয়েছে, তারা চরম সংকটে পড়ত। সেদিক থেকে ঋণশোধের সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রক ঠিক কাজই করেছে। অবশ্য কেউ কেউ মনে করছেন, পরিশোধের সময়সীমা না বাড়িয়ে যে ঋণগুলো ছোট এবং মাঝারি সংস্থাদের দেওয়া হয়েছে, সেগুলো একেবারে মকুব করে দিলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি আরও তাড়াতাড়ি চাঙ্গা হয়ে উঠত। ঋণ-মকুব প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব।
অর্থমন্ত্রী ভাবছেন, তালাবন্দি উঠে গেলে কম সুদে,সহজ শর্তেধার নিয়ে ছোট এবং মাঝারি সংস্থাগুলো খুব সহজেই আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। কম সুদে নতুন ঋণ পেলে কেউ কেউ হয়ত নতুন ঋণ দিয়ে পুরোনো ঋণ শোধ করে দেবে। ফলে সামগ্রিকভাবে কোম্পানির খরচ কমে আসবে, স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে। আবার কেউ কেউ হয়ত নতুন ঋণ নিয়ে নতুন বিনিয়োগ করবে, কম্পানিটাকে আরও বড় করবে। সেখানে নতুন কর্মসংস্থানও হতে পারে। যাতে নতুন বিনিয়োগ তথা আয়তন বৃদ্ধিতে কোনও বাধা না আসে, তাই অর্থমন্ত্রক ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থার আওতায় বছরে একশ’ কোটি টাকা অবধি লেনদেন করে এমন কোম্পানিদের নিয়ে এসেছে।
ভাল কথা। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে গেলে যে ছোট এবং মাঝারি কোম্পানিগুলোর দিকেই প্রাথমিকভাবে তাকাতে হবে, এ-নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু ঋণের যোগান বাড়ালেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাগুলোর স্বাস্থ্যোন্নতি ঘটবে কি? অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, না, ঘটবে না। শুধু ঋণের যোগান বাড়িয়ে বা শর্ত শিথিল করে এই সংস্থাগুলোকে করোনা সংকটের গহ্বর থেকে টেনে তোলা যাবে না। এর জন্যে আলাদা করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কেন অর্থনীতিবিদরা আলাদা করে ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবার ওপর জোর দিচ্ছেন সেটা পরিষ্কার করে বোঝা দরকার।
ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে কেন অর্থনীতির স্বাস্থ্য ফেরা সম্ভব নয় সেটা একটা স্তর অবধি বোঝা সহজ। ক্রেতারা জিনিসপত্র না কিনলে কোম্পানিগুলো উৎপাদন করবে না। লোক-নিয়োগ করবে না। বিনিয়োগও করবে না। কোম্পানিদের উৎপাদিত পণ্য যদি অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে থাকে তাহলে তারা নতুন ঋণ নিয়ে আয়তন বৃদ্ধি করবে কেন? কী করেই বা পুরোনো ধার শোধ করবে?কিন্তু এর উল্টোদিকেও যুক্তি আছে। কেউ বলতেই পারেন, তালাবন্দি উঠে গেলে ধীরে ধীরে কোম্পানিগুলো খুলবে, আবার উৎপাদন শুরু হবে, কর্মচারিরা তাঁদের বেতন পেতে শুরু করবেন। বেতন হাতে পেলে তাঁরা জিনিসপত্র কিনতে শুরু করবেন, ফলে কম্পানিদেরও উৎপাদন চালিয়ে যাবার উৎসাহ থাকবে। এক কম্পানির কর্মচারি আর এক কম্পানির জিনিস কিনবেন, এক কম্পানিতে অর্জিত আয় অন্য কম্পানিতে খরচ হবে। এইভাবে আয়ের বৃত্তাকার প্রবাহ, অর্থনীতির পরিভাষায় যার নাম সার্কুলার ফ্লো অফ ইনকাম, আবার পুনরুজ্জীবিত হবে, তালাবন্দির ফলে যা থেমে গিয়েছিল।
অর্থাৎ অর্থমন্ত্রীর সমর্থকরা বলবেন, তালাবন্দির অভিঘাতজিনিসপত্রের উৎপাদন ও বন্টনে যে আঘাত হেনেছিল, তাকে পুরোপুরি যোগান ভিত্তিক বলা চলে। তালাবন্দি উঠে গেলে এই অভিঘাত মিলিয়ে যাবে, আস্তে আস্তে অর্থনীতি আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তাই আলাদা করে চাহিদা বাড়াবার কোনও প্রয়োজন নেই। অর্থনীতি যাতে তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তার জন্য বরং যোগানের দিকটা আরও মসৃণ করা যেতে পারে। সহজ শর্তে অপর্যাপ্ত ঋণ, অর্থমন্ত্রীর সহযোগীরা বলবেন, যোগান ব্যবস্থাকে মজবুত করে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ত্বরান্বিত করবে। আর যোগান ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেলে চাহিদা নিজের থেকেই তৈরি হয়ে যাবে। তার জন্য আলাদা পদক্ষেপ করার দরকার নেই। দুর্ভাগ্যবশত, এই ভাবনায় গুরুতর গলদ আছে।
আমরা জানি, দেশে একশ’ টাকা উৎপাদন হলে সেই উৎপাদন ঠিক একশ’ টাকারই আয় তৈরি করে। সেই আয় শ্রমিকের মজুরি, উদ্যোগপতির লাভ, উত্তমর্ণের সুদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের দাম ইত্যাদি নানা আকারে নানা মানুষের হাতে জমা পড়ে। কিন্তু উৎপাদনের ফলে যাদের আয় বাড়ল তারা কি তাদের বর্দ্ধিত আয়ের পুরোটাই জিনিসপত্র কিনে খরচ করেন? যদি করতেন তাহলে একশ’ টাকার উৎপাদন বাড়লে একশ’ টাকার চাহিদা বাড়ত, যোগান ও চাহিদার মধ্যে কোনও অসামঞ্জস্য থাকত না। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে মানুষ তার আয়ের পুরোটা খরচ করে না, আয়ের একটা অংশ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখে। যে আয়টা সঞ্চিত হয়ে রইল তার ঠিক সমান মূল্যের উৎপাদন কিন্তু ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিক্রি হল না। অর্থাৎ সঞ্চয়ের কারণে যোগান এবং চাহিদার মধ্যে একটা ফারাক রয়ে গেল। এই ফারাকটা, অর্থাৎ আয়ের সঞ্চিত অংশটা, পূরণ হয় বিনিয়োগের চাহিদা দিয়ে। উৎপাদনের যে অংশটা ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিক্রি হল না, স্বাভাবিক অবস্থায় সেটা বিনিয়োগের চাহিদা মেটায়। কিন্তু এর জন্য স্বতস্ফূর্তভাবে বিনিয়োগের চাহিদা থাকা দরকার।
দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, বর্তমান পরিস্থিতিতেবেসরকারি বিনিয়োগের চাহিদা কম হবারই সম্ভাবনা। এই সংকটের সময় কোন উদ্যোগপতি সাহস করে বিনিয়োগ করবেন? আর বিনিয়োগের চাহিদা না থাকলে সঞ্চয়ের অংশটা অবিক্রিতই পড়ে থাকবে। বস্তুত, দু’টো বিশেষ কারণে এই সংকটের মুহূর্তে জিনিসপত্র অবিক্রিত পড়ে থাকার সমস্যাটা গভীরতর। এক, যেহেতু ভবিষ্যৎ এখনও অত্যন্ত অনিশ্চিত, তাই তালাবন্দি উঠে যাবার পর হাতে কিছু পয়সা এলে অনেক মানুষ আগের থেকে বেশি সঞ্চয় করবেন। দুই, তালাবন্দির সময় অনেকেরই পুরোনো সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ খরচ হয়ে গেছে। এঁরা তালাবন্দির পর বাড়তি সঞ্চয় করে সেই খরচ হয়ে যাওয়া অংশের খানিকটা আবার পূরণ করে ফেলার চেষ্টা করবেন। সব মিলিয়ে সঞ্চয়ের অনুপাত বাড়বে আর তার সঙ্গে যেহেতু বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা কম, ফলে চাহিদায় ঘাটতি দেখা দেবে।
এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় চাহিদা বাড়ানো। চাহিদা দু’ভাবে বাড়ানো যেতে পারে। প্রথমত, মানুষের হাতে, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের হাতে, সরাসরি কিছু টাকা পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। গ্রহীতাএই টাকাটা ভোগ্যপণ্যের ওপর সরাসরি খরচ করে জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়াবেন। দ্বিতীয়ত, সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে দেশে যে শুধু জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়বে তাই নয়, সরকারি বিনিয়োগের ফলে দেশের পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটবে। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগও খানিকটা বাড়তে পারে। গত বছর স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী পরিকাঠামোয় যে বিপুল বিনিয়োগের কথা বলেছিলেন, যার প্রতিধ্বনি অর্থমন্ত্রীর এবছরের বাজেট বক্তৃতাতেও শোনা গিয়েছিল, এখনই তো সেই বিনিয়োগ করার সময়। তার কথা আর আমরা শুনতে পাচ্ছি না কেন?
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
খবর (News) লেটেস্ট খবর এবং আপডেট জানার জন্য দেখুন এবিপি লাইভ। ব্রেকিং নিউজ এবং ডেলি শিরোনাম দেখতে চোখ রাখুন এবিপি আনন্দ লাইভ টিভিতে
আরও দেখুন
Advertisement
ট্রেন্ডিং
Advertisement
Advertisement
সেরা শিরোনাম
জেলার
জেলার
মালদা
আজ ফোকাস-এ
Advertisement