![ABP Premium](https://cdn.abplive.com/imagebank/Premium-ad-Icon.png)
সত্যজিতের প্রিয় নায়ক, অভিনয় শিখেছেন শিশির ভাদুড়ির কাছে, জাতীয়-আন্তর্জাতিক দর্শককে বারবার অবাক করেছেন সৌমিত্র
যে সৌমিত্রকে বাঙালি দর্শক চিনেছিল দেবী, সমাপ্তি-র মত ছবিতে, তিনিই হয়ে উঠলেন ময়ূরবাহন, যার রূপ ছিল চোখ ঝলসানো, ভেতরটাও ছিল ততটাই ক্রূর।
![সত্যজিতের প্রিয় নায়ক, অভিনয় শিখেছেন শিশির ভাদুড়ির কাছে, জাতীয়-আন্তর্জাতিক দর্শককে বারবার অবাক করেছেন সৌমিত্র Soumitra Chattopadhyay- a colossal actor in Bengali film industry সত্যজিতের প্রিয় নায়ক, অভিনয় শিখেছেন শিশির ভাদুড়ির কাছে, জাতীয়-আন্তর্জাতিক দর্শককে বারবার অবাক করেছেন সৌমিত্র](https://static.abplive.com/wp-content/uploads/sites/3/2020/11/15121040/web-soumitra-end-card-still-151120.jpg?impolicy=abp_cdn&imwidth=1200&height=675)
কলকাতা: নাট্যাচার্যের খাতা। সাতান্ন সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তাতে ষষ্ঠ বর্ষের এক ছাত্রের কথা লিখেছিলেন শিশির ভাদুড়ি। ‘অনেকক্ষণ বকলাম। আ লাইকলি মেরিট ফর দ্য স্টেজ।’ এরপর বকুনি খাওয়া ২২ বছরের সেই তরুণকেই তিনি সুযোগ দেন প্রফুল্ল নাটকে সুরেশের চরিত্রে। বাংলা অভিনয়ের জগতে আবির্ভূত হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামে ক্ষণজন্মা প্রতিভা।
জন্ম নদিয়ায়, ১৯৩৫-এর ১৯ জানুয়ারি। ডাকনাম পুলু। বাবা মোহিত চট্টোপাধ্যায় কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন। মা আশালতা চট্টোপাধ্যায়। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে পাশ করার পর সৌমিত্র সিটি কলেজ থেকে আইএসসি ও বাংলায় অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেন। তারপর ভর্তি হন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টসে। কলেজে পড়তে পড়তেই দেখেছিলেন শিশির ভাদুড়ির একটি নাটক, যা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পরিচয় হয় ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে, শুরু হয় মঞ্চে অভিনয়। অসমবয়সী দুই অভিনেতার মধ্যে গড়ে ওঠে অদ্ভুত বন্ধুত্ব, যার কথা বারবার উঠে এসেছে সৌমিত্রের স্মৃতিচারণে।
নীলাচলে মহাপ্রভু ছবি দিয়ে বড় পর্দায় পা রাখার কথা ছিল। কিন্তু বাদ পড়েন একেবারে শেষ মুহূর্তে, সুযোগ পান অসীম কুমার। এরপর ১৯৫৬। সত্যজিৎ রায় তখন অপরাজিত-র জন্য খুঁজছেন নতুন মুখ। ২০ বছরের সৌমিত্রকে পছন্দ হয় তাঁর কিন্তু মনে হয়, কিশোর অপুর পক্ষে একটু বেশি লম্বা। কেটে যায় ২ বছর। সত্যজিৎ তখন জলসাঘর নিয়ে ব্যস্ত। দেখা করতে গিয়েছেন সৌমিত্র। সত্যজিৎ তাঁকে নিয়ে যান ছবি বিশ্বাসের কাছে। বলেন, ‘এ হল সৌমিত্র, আমার পরের ছবি অপুর সংসার-এ অপু চরিত্রে অভিনয় করছে।‘ তারপরের অধ্যায় চিরকালীন স্থান পেয়েছে বাংলা ছবির ইতিহাসে।
বিভূতিভূষণের যে শিশু অপু দিদির হাত ধরে অবাক চোখে দুনিয়া চিনেছিল, সে তখন সদ্য তরুণ। জীবন সংগ্রাম শুরু হয়েছে, পাকেচক্রে বিয়েও করে ফেলেছে। বাঙালি মননে অমরত্ব পেয়েছে অপু আর তার কিশোরী পত্নীর সদ্য ফোটা রোমান্স। তারপর স্ত্রীর মৃত্যু, ছেলেকে কাঁধে বসিয়ে যুবক অপুর যাত্রা দিকশূন্যপুরের দিকে। অপূর্বকুমার রায়ের অতি অসামান্য, অতি অকিঞ্চিৎকর জীবন এত অনায়াসে কে ফুটিয়ে তুলতে পারত সৌমিত্র ছাড়া?
সৌমিত্র যখন এলেন, বাংলা সিনেমার আকাশে তখন দুপুরের উজ্জ্বলতায় জ্বলছেন উত্তর কুমার। রয়েছেন কমল মিত্র, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত কালজয়ী অভিনেতারা। সেই সোনার সময়েও বাঙালি দর্শকের নজর আলাদা করে কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন সৌমিত্র। শুধু সত্যজিতের পরপর ছবিতে অভিনয় নয়, তপন সিংহের ঝিন্দের বন্দি-তে তিনি প্রমাণ করলেন, খল চরিত্রেও তিনি একইরকম স্বচ্ছন্দ। যে সৌমিত্রকে বাঙালি দর্শক চিনেছিল দেবী, সমাপ্তি-র মত ছবিতে, তিনিই হয়ে উঠলেন ময়ূরবাহন, যার রূপ ছিল চোখ ঝলসানো, ভেতরটাও ছিল ততটাই ক্রূর।
সত্যজিতের সব থেকে পছন্দের নায়ক। অপুর সংসার থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা থামল ১৯৯০-এ শাখা প্রশাখা-য়। সব মিলিয়ে ১৪টি ছবি। চারুলতা-র অমলই হোক বা হীরক রাজার দেশে-র উদয়ন পণ্ডিত- বিশপ লেফ্রয় রোডের বাসিন্দার ছবি মানেই সৌমিত্রের উপস্থিতি। সত্যজিৎ ফেলুদা করলেন, সেখানেও তিনি মুখ্য চরিত্র। আর বাঙালি পেল নতুন ফ্যাশন, পাঞ্জাবির সঙ্গে প্যান্ট, ধুতি বা পাজামার বদলে।
১৯৬০-এ বিয়ে করেন সৌমিত্র। স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়, দুই সন্তান, সৌগত এবং পৌলমী।
১৯৮৪-তে মুক্তি পেল কোনি। তনুজাকে দেখে এক সময় রাস্তায় ট্যুইস্ট নাচা তরুণ তখন মধ্যবয়সী, সাঁতার শেখাচ্ছেন বস্তির মেয়ে কোনিকে, দিচ্ছেন জীবনযুদ্ধে ট্রেনিং। তাঁর সেই ফাইট কোনি ফাইট চিৎকার বাংলা ছবিতে মাইলস্টোন হয়ে আছে।
এরপর আতঙ্ক। সেই হাড়হিম করা হুমকি, মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি। আচমকা খুনের সাক্ষী হওয়া এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের অসহায়তা কাঁপিয়ে দিয়েছিল দর্শককে। আর সৌমিত্র বুঝিয়েছিলেন, তাঁর অভিনয়ের রেঞ্জ সম্পর্কে সত্যি আমরা কত কম জানি।
১৯৭০-এ তাঁকে ভারত সরকার পদ্মশ্রী দিতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরে বলেছিলেন, ওই সময়টা সরকার চলচ্চিত্রের জন্য কিছু করেনি, তাই আলাদা করে ব্যক্তি হিসেবে পুরস্কার নিতে চাননি। ২০০৪-এ পান পদ্মভূষণ, ২০১২-য় দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, তার ৬ বছর পর ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান লেজিয়ঁ দ্য'নর, একই বছরে শিল্পীদের জন্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান কমান্দার দ্য ল'র্দ্র দেজার্ত এ দে লেত্র। কিন্তু শুধু তো চলচ্চিত্র নয়, সৌমিত্র মানেই মঞ্চাভিনয়, আবৃত্তি, কবিতাচর্চা, সাহিত্য সৃষ্টি সহ এক সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব, গোটা জীবন যাঁর আত্ম আবিষ্কার থামেনি। টিকটিকি, কিং লিয়র-এর মত নাটকে তাঁর অভিনয় দর্শক মনে রেখেছেন ভালবাসা ও শ্রদ্ধায়।
কিন্তু সব কিছুর পরেও সৌমিত্রর কথা ভাবলে যেন সেই কোনি-র ক্ষিদ্দার কথাই মনে পড়ে। জীবনযুদ্ধে কোণঠাসা মধ্যবয়সী সাঁতার মাস্টার আঁকড়ে ধরেছেন কিশোরী ছাত্রীকে, তার জয় পরাজয়ে আটকে রয়েছে তাঁর জীবনের ওঠানামা। ছবির শেষ কয়েক মিনিটে তলোয়ারের মত ঝলসে উঠেছিল সৌমিত্রের কালজয়ী প্রতিভা, অপু, উদয়ন পণ্ডিত, ময়ূরবাহনরা যেন মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছিল ছাপোষা ক্ষিতীশ সিংহের মধ্যে। বাংলা ছবির ছোট্ট চণ্ডীমণ্ডপকে মুহূর্তে আন্তর্জাতিকতায় উন্নীত করেছিল সৌমিত্রের অভিনয়। সিনেমা যতদিন মানুষের মনের কথা বলবে, ততদিন থাকবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তাঁর এক আকাশ অভিনয় দক্ষতা নিয়ে।
ট্রেন্ডিং
সেরা শিরোনাম
![ABP Premium](https://cdn.abplive.com/imagebank/metaverse-mid.png)