Digha Jagannath Temple: শুধুই পুরীর আদলে নয়, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে অযোধ্য়ার রাম মন্দিরের মিল কোথায় ?
Digha Jagannath Temple Update: অক্ষয় তৃতীয়ার দিন, উদ্বোধন হবে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের, জোরকদমে চলছে শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি

অর্ণব মুখোপাধ্য়ায়, কলকাতা: অক্ষয় তৃতীয়ার দিন, উদ্বোধন হবে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের। জোরকদমে চলছে শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি। নীল সমুদ্র আর সোনালি বালির তটে, এবার এক নতুন আকর্ষণ। আমাদের রাজ্য়ের দিঘায়, সারা দেশের পুণ্য়ার্থী এবং পর্যটকদের স্বাগত জানাতে তৈরি, জগন্নাথদেবের মন্দির। একেবারে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে। সেই স্থাপত্য়, সেই উচ্চতা। মুখ্য়মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, মন্দিরের উদ্বোধন হবে অক্ষয় তৃতীয়ায়। তার আগে কীভাবে সেজে উঠছে দিঘার জগন্নাথ ধাম? কেমন দেখতে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের গর্ভগৃহ, জগমোহন, নাটমণ্ডপ, ভোগমণ্ডপ? বেলে পাথরের দেওয়ালে কোন শিল্পকলা থাকছে? অযোধ্য়ার রাম মন্দিরের সঙ্গেই বা এই মন্দিরের মিলটা কোথায়? চলুন দেখে নেওয়া যাক।
নীল জলরাশি, দিগন্ত বিস্তৃত বালিয়াড়ি। পাড় ঘেঁষে ঝাউবনের সারি। বাঙালির ২ দিনের ছুটি মানেই ডেস্টিনেশন দিঘা। কিন্তু, দিঘার পর্যটন মানচিত্রে এবার ঘোরাঘুরির সঙ্গে ভক্তিভাবের মিশেল।সৌজন্য়ে এই সুবিশাল চোখ ধাঁধানো জগন্নাথ মন্দির।যেমন - মন্দিরের মাথার চূড়ো। দেওয়ালে অপূর্ব কাজ। ভিতরে পিঙ্ক বেলেপাথরের ওপর কাজ। এক্কেবারে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে তৈরি। সেই স্থাপত্য় । সেই উচ্চতা । পুরীর মন্দিরের আদলেই দিঘার জগন্নাথ ধাম। যেরকম বলা হচ্ছে, এই মন্দির নাগর শৈলি রীতিতে তৈরি। এতে রয়েছে কলিঙ্গ স্থাপত্য়ের প্রভাব।
গতবছর ডিসেম্বরে মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় বলেছিলেন, পুরীর সঙ্গে নিশ্চয়ই আমরা তুলনা করব না। ওদেরটা রাজ-রাজারা করেছেন দীর্ঘদিন আগে। আমাদেরটা আমরা সরকারের পক্ষ থেকে করছি। টোটাল টাকাটাই সরকারের। দিঘা রেল স্টেশনের একেবারে কাছেই মাথা তুলেছে এই জগন্নাথ মন্দির। ২০ একর জায়গার ওপর, এই মন্দির নির্মাণ করেছে হিডকো। ৩০ তারিখ, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মন্দিরের উদ্বোধন হবে। মুখ্য়মন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, এবছরই অক্ষয় তৃতীয়ার দিন উদ্বধন হবে দিঘার জগন্নাথ ধামের। তার আগের দিন থেকে শুরু হবে যাগযজ্ঞ। পুরীর মন্দিরের আদলে তৈরি হয়েছে এই মন্দির। উচ্চতাও সমান সমান। ২০ একর জায়গা। ২০০ কোটি টাকা খরচ। তার থেকে বেশিও খরচ হতে পারে।
মন্দিরের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের পর, প্রথমেই পড়বে দীপস্তম্ভ।সমুদ্রের দিকের রাস্তা থেকে জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করলেই ২ হাতে চোখে পড়বে এই ধরনের স্তম্ভ। যা উজ্জ্বয়িনীর মন্দিরের দীপ জ্য়োতি স্তম্ভের কথা মনে করিয়ে দেবে। পুরীর মন্দিরের মতোই, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরেও ৪টি দুয়ার। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের পর, প্রথমেই চোখে পড়বে এই অরুণ স্তম্ভ। পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরের সামনে রয়েছে অরুণ স্তম্ভ। মনে করা হয়, কোনও এক সময় কোনারক থেকে এই অরুণ স্তম্ভটি নিয়ে এসে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সামনে স্থাপন করা হয়। বৈদিক যুগে সূর্য ও বিষ্ণুকে অভিন্ন মনে করা হত। তাই বিষ্ণু জগন্নাথ মন্দিরের সামনে অরুণ স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। দিঘাতেও মন্দিরের সামনে রয়েছে এই স্তম্ভ।
অরুণ দুয়ার পার করে, একটু এগোলেই, সামনে পড়বে সিংহ দুয়ার। দিঘার মন্দিরে ঢুকতে হলে, ৪ টি প্রবেশ দ্বার রয়েছে। অরুণ স্তম্ভের ঠিক পরেই রয়েছে, সিংহদুয়ার।সিংহ দুয়ারের ঠিক উল্টোদিকে ব্য়াঘ্র-দুয়ার। মন্দিরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, বাঁ হাতে পড়বে হস্তি দুয়ার। আর ডানদিকে, অশ্ব দুয়ার। ঠিক যেমনটা রয়েছে পুরীর মন্দিরে। তবে, হস্তি দুয়ার ও অশ্ব দুয়ার মন্দিরের সঙ্গেই লাগোয়া। পুরীর মন্দিরে যেমন, বাইরে থেকেই দেখা যায়, জগন্নাথ দেবের পতিত পাবন মূর্তি,দিঘাতেও, তেমন সিংহ দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করেই দেখা মিলবে জগন্নাথ দেবের।
পুরীর মন্দিরের মতোই, এখানেও মূল মন্দিরের ৪টি ভাগ। গর্ভগৃহ। তার সামনে জগমোহন।তারপর নাটমণ্ডপ। তারপর ভোগমণ্ডপ। মন্দিরে প্রবেশ করার পর, প্রথমেই পড়বে ভোগ মণ্ডপ। ভোগ মণ্ডপে ৪টি বড় দরজা। মন্দিরে প্রবেশ করার পর, প্রথমেই রয়েছে ভোগ মণ্ডপ। এই ভোগ মণ্ডপ থেকে, যদি আরেকটু এগিয়ে যাই, এরপরই নাটমণ্ডপ বা নাট মন্দির। এই নাটমন্দিরে পরপর ১৬টি স্তম্ভ রয়েছে। এই ১৬টি স্তম্ভই কিন্তু নাটমন্দিরকে ধরে রেখেছে। এখানে পাথর কেটে কটে বিভিন্ন রকমের নকসা। পাথর কেটে কেটে খুব সুন্দর করে নকসা গুলি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
পুরীর মন্দিরের মতোই, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরেও, নাটমণ্ডপের পরেই রয়েছে জগমোহন। নাটমন্দিরে ৪টি ছোট ও ২ টি বড় দরজা।এবং ভোগ মণ্ডপে ৪টি বড় দরজা। পুরীর মন্দিরেও ৪টি ভাগ। গর্ভগৃহ, দেউল, তারপরে জগমোহন, তারপরে নাটমণ্ডপ, তারপরে ভোগ মণ্ডপ। দিঘার মন্দিরেও একইভাবে তৈরি হয়েছে সবকিছু। আমরা এখন রয়েছি জগমোহন। দেখতে পাচ্ছি, এখনে রয়েছে ৪টি স্তম্ভ। জগমোহন আর ভিতরে যে গর্ভগৃহ এই দুটোই কিন্তু পুরোপুরি এয়ার কন্ডিশন। মেঝেতে সুন্দর নকসা।
নাটমন্দির ও ভোগমন্ডপ, এর মাঝখানে রয়েছে, এই গরুড় স্তম্ভ। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে গরুড় স্তম্ভ। গরুড় বিষ্ণুর বাহন। তাঁর দৃষ্টি জগন্নাথ দেবের পদতলে। কথিত আছে, শ্রীচৈতন্য়দেব পুরীর মন্দিরে এই গড়ুর স্তম্ভের পিছনে দাঁড়িয়েই জগন্নাথ দেবের দর্শন করতেন। এমনকী তাঁর হাতের ছাপ রয়ে গেছে ভোগ মণ্ডপের দেওয়ালে। দেউল বা ভিমানার নীচে রয়েছে গর্ভগৃহ। নাটমণ্ডপে প্রবেশ ও প্রস্থানের দরজায় কালো পাথর দিয়ে ছোট ছোট করে তৈরি করা হয়েছে দশাবতার মূর্তি।
গর্ভগৃহে এই বেদির ওপরেই থাকবে, জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর মূর্তি। পুরীতে এই বেদীকে বলা হয় রত্নদেবী। কারণ, এই রত্নদেবীর ভিতরে রয়েছে ১ লক্ষ শালগ্রাম শিলা। তার ওপরেই তিন বিগ্রহ। পুরীর সেই রত্নবেদীর আদলে দিঘায় এই রত্নবেদী তৈরি হয়েছে। কথিত আছে, জগন্নাথ দেব সর্বদা রত্নবেদীর ওপরেই আসীন থাকেন। শোনা যায়, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে যবন আক্রমণের সময়, যতবার জগন্নাথ দেবকে লুকিয়ে অন্য়ত্র সরানো হয়েছে, ততবারই রত্মবেদীর ওপরই বসানো হয়েছে।
পুরী মন্দিরের জগন্নাথ দ্বৈতাপতি বলেন, পুরীর মন্দিরে জগন্নাথদেবের আগমনের নেপথ্যে রয়েছে পৌরাণিক গাঁথা। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর স্বপ্নে দেখা দেন তাঁর পরমারাধ্য শ্রীনীলমাধব। তিনি বলেন, নীলমাধব রূপে তুমি আমাকে মন্দিরে পাবে না। আমি আসব মহাকাষ্ঠরূপে। পরদিন সকালে রাজা সমুদ্রতীরে গিয়ে দেখেন, সত্যিই সেখানে একটি কাষ্ঠখণ্ড রয়েছে। যার গায়ে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম আঁকা। সেই কাঠ দিয়ে, ত্রিমূর্তি নির্মাণ শুরু করেন, বিশ্বকর্মার গুরু বাসুদেব মহারাণা। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী, মূর্তি নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই, ঘরের ভিতর প্রবেশ করেন ইন্দ্রদ্য়ুম্ন।
তখনই, কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই, চোখের নিমেষেই মিলিয়ে যান মহারানা। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দেখেন, ভগবানের তিনটি বিগ্রহ, হাত ও পায়ের আঙুল তৈরি হয়নি। পুরীর জগন্নাথ-বলমার-সুভদ্রার মূর্তি নিমকাঠের। দিঘার মূল মন্দিরে থাকবে মার্বেলের মূর্তি। তবে, পুজো হবে কাঠের দারু মূর্তি। রথের দিন, এই দারু মূর্তি নিয়েই হবে রথযাত্রা। এখানে তিন বিগ্রহের জন্য় থাকছে তিনটি সুদৃশ খাট। জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রাদেবীর রাতের শয়নের ব্য়বস্থা। তার জন্য় এরকম তিনটি খাট। খাটে নানা ধরনের নকসা। কাঠের ওপর নকসা ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। পুরী মন্দিরের জগন্নাথ দ্বৈতাপতি বলেন,খুব ভালো হয়েছে। মানুষ স্মরণ করতে পারবে।
বেলে পাথরের দেওয়ালে অপূর্ব শিল্পকলা। ইতি-উতি ছড়িয়ে রয়েছে ভাস্কর্য। মন্দিরের গায়ে অপূর্ব কারুকাজ। পৌরাণিক কাহিনীর বর্ণনা। কাঠের দরজার অপরূপ কাজ। অযোধ্য়ার রামমন্দিরের ভিতরের দরজাগুলিতে রয়েছে সোনার পাত। দিঘার এই জগন্নাথ মন্দিরে বড় বড় কাঠের দরজা। বিভিন্ন নকসা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ফুল, অনেকগুলি দরজা। প্রতিটা দরজায় কাঠের কাজ অনবদ্য়। রাজস্থানের বংশীপাহাড়পুরের বেলে পাথর... যা কিনা ব্য়বহৃত হয়েছে রাম-মন্দিরের একটা বড় অংশে। রাজস্থান থেকে বেলে পাথর আনা হয়েছে। যা দিয়ে তৈরি হচ্ছে রামমন্দিরের দেউল। সেই গোলাপি পাথর দিয়েই তৈরি হয়েছে এই মন্দির।
দিঘার পুরনো জগন্নাথ মন্দিরেরও রয়েছে একটি ইতিহাস। আগে এই জায়গায় মৎস্যজীবীদের আরাধ্যাদেবী মা গঙ্গা ও মহাকাল মূর্তির পুজো করা হত।১৯৮৫ সাল (বাংলা ১৩৯২ সন) থেকে হয়ে আসছিল সেই পুজো। প্রথমে দুটি মূর্তির পুজো হত তালপাতার তৈরি অস্থায়ী মন্দিরে। সেখানে পুজোপাঠ করতেন নন্দীগ্রাম থেকে আসা সাধু বলরাম দাস। অস্থায়ী মন্দিরের পাশেই পাতার ছাউনিতে থাকতেন তিনি।মন্দিরের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ও তার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় খাদালগোবরা গ্রামের বাসিন্দা, সাবিত্রী প্রামাণিক নামে এক মহিলা। সৈকত শহর দিঘায় বেড়াতে আসা অনেক পর্যটকই ওই মন্দিরে যেতেন। তেমনই এক পর্যটক দম্পতি হলেন কলকাতার পূর্ব আনন্দপল্লির বাসিন্দা সমীর মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী উর্মিলা দেবী।
আরও পড়ুন, এক এপিকে দুই ভোটার ! 'ভূতেরাই' ছাব্বিশের ভবিষ্যৎ?
দিঘা বেড়াতে গেলেই নিরিবিলিতে থাকা মা গঙ্গা ও মহাকালের অস্থায়ী মন্দিরে যেতেন তাঁরা। মন্দিরের পূজারী সাধু বলরাম দাস ও স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে তাঁদের। কথিত আছে, দিনটা ছিল বাংলার ১৪১৩ সালের ৬ চৈত্র, বুধবার। সন্ধে ৭টা নাগাদ সমুদ্র তটে অস্থায়ী মন্দিরের পাশে বসে মৎস্যজীবীদের সঙ্গে গল্প করছিলেন সমীর মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী উর্মিলা দেবী। হঠাৎ জ্যোৎস্নার আলোয় তাঁরা দেখতে পান, সমুদ্রে তিনটি মূর্তি ভাসছে। সেই সময় জোয়ার চলছিল। মৎস্যজীবীরা রাতেই নৌকা ভাসিয়ে সমুদ্রে ভাসতে থাকা তিনটি মূর্তি উদ্ধার করেন।দেখা যায়, মূর্তি তিনটি হল জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রার। সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত হয়, মা গঙ্গা ও মহাকালের অস্থায়ী মন্দিরেই তিনটি মূর্তির প্রতিষ্ঠা করা হবে।তখন থেকেই দিঘায় দারুব্রহ্মের পুজোঅর্চনা শুরু। পরে, কলকাতার বাসিন্দা, সমীর মণ্ডল ও স্থানীয়দের আর্থিক সহযোগিতায় স্থায়ী মন্দির গড়ে ওঠে। আরও পরে কাঁথির জুনপুট গ্রামের বাসিন্দা, মাছ ব্যবসায়ী শ্রীমন্তকুমার শীটের আর্থিক সহযোগিতায় নব কলেবরের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
ট্রেন্ডিং
সেরা শিরোনাম
