North 24 Parganas History: একদিকে দক্ষিণেশ্বর, অপরদিকে ইকোপার্ক, আধুনিকতা-ইতিহাসের মেলবন্ধনের সাক্ষী উত্তর ২৪ পরগনা
North 24 Parganas Profile: ১৯৮৬ সালে পাঁচ সাব-ডিভিশন, বারাসাত (প্রধান কার্যালয়), ব্যারাকপুর, বসিরহাট, বনগাঁ ও বিধাননগর নিয়ে তৈরি হয় আজকের উত্তর ২৪ পরগনা।
উত্তর ২৪ পরগনা: চারিপাশে একগুচ্ছ জেলা, রয়েছে পড়শি বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলপথে ও জলপথে যোগাযোগের সুযোগও। উত্তর ২৪ পরগনার (North 24 Parganas) পরতে পরতে ইতিহাস। একদিকে যেখানে দক্ষিণেশ্বর, আদ্য়াপীঠের অবস্থান বারবার পুণ্য়ার্থীদের টেনে নিয়ে আসে এই জেলায়, তেমনই অত্যাধুনিক ইকো পার্কও বর্তমানে এই জেলার অন্যতম বিখ্যাত ঘোরার জায়গা। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের সুবন্দোবস্ত এবং মনোরম জলবায়ুই সম্ভবত আয়তনে মাত্র দশম দীর্ঘতম হওয়া সত্ত্বেও, উত্তর ২৪ পরগনাকে রাজ্যের সর্বাধিক জনবহুল জেলা (ঘনত্বের বিচারে দ্বিতীয়) করে তুলেছে।
ইতিহাস
২৪ পরগনা মুঘল যুগে সপ্তগ্রাম প্রশাসনের অধীনে ছিল। পরবর্তী সময়ে মুর্শিদ আলি খাঁর আমলে এটি হুগলি-চাকলা প্রশাসনের অধীনে চলে যায়। তবে ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর মীরজাফর রাজারহাট, বাঘজোলা, বিরাটির মতো মোট ২৪টি পরগনার জমিদারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দেন। সেখান থেকে একত্রিতভাবে এই ভূখন্ডকে ২৪ পরগনা নামকরণ করা হয়।
এরপর গোটা ইংরেজ শাসনকালে চলেছে ভাঙাগড়ার কাজ। কখনও গোটা সুন্দরবনকে (১৭৯৩ সালে) কর্নওয়ালিশের শাসনকালে ২৪ পরগনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কখনও আলিপুর ও বারাসাত, দুই জেলায় এটিকে ভাগ করা হয়েছে। কখনও আবার ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় অধুনা বাংলাদেশের সঙ্গে সুন্দরবনকে জেলা থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে। তবে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বনগাঁর মতো বেশ কিছু অংশ আবারও ২৪ পরগনার সঙ্গে জুড়ে এপার বাংলার ভাগেই দেওয়া হয়। তবে ভাঙণ যেন ২৪ পরগনার ভাগ্যেই ছিল। ১৯৮৩ সালে অশোক মিত্রের নেতৃত্বে গঠিত এক কমিটি ২৪ পরগনাকে দুইভাগে বিভক্ত করার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ মেনেই ১৯৮৬ সালে পাঁচ সাব-ডিভিশন, বারাসাত (প্রধান কার্যালয়), ব্যারাকপুর, বসিরহাট, বনগাঁ ও বিধাননগর নিয়ে তৈরি হয় আজকের উত্তর ২৪ পরগনা।
অবস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা
এই জেলার ভৌগলিক অবস্থান জেলাটিকে সাধারণ নাগরিকদের বসবাসের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ৪০৯৪ স্কোয়ার কিলোমিটার বিস্তৃত। এই জেলার উত্তরে নদীয়া, দক্ষিণে রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্বে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমে হাওড়া, হুগলি ও কলকাতা। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলপথে বনগাঁর পেট্রাপোলের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে।
এই জেলা থেকে স্থলপথ, জলপথ ও রেলপথ, তিন মাধ্য়মেই খুব সহজেই, অল্প সময়ে কলকাতায় পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। জেলার প্রধান কার্যালয় বারাসাত, কলকাতা বিমানবন্দর থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এছাড়া শিয়ালদা সরাসরি এক ট্রেনেই বারাসাত স্টেশন পৌঁছে যাওয়ার সুবিধা রয়েছে। মহানগরীর সঙ্গে এই যোগাযোগ ব্য়বস্থা কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনা জেলাটি জনবহুল হওয়ার অন্যতম কারণ। প্রায় ১ কোটি ১০ হাজার (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী) মানুষেক বাস এই জেলায়।
ভূ-পরিচয়
উত্তর ২৪ পরগনা জেলাটি সিংহভাগ অঞ্চলই সমতলে অবস্থিত। জেলা নদীর আধিক্য এবং বিশেষ করে দক্ষিণভাগ গঙ্গা উপকূলে অবস্থিত হওয়ায় পলিমাটির পরিমানই বেশি। এই উর্বর পলিমাটি চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তবে অবস্থান অনুযায়ী মাটিতে বালির উপস্থিতির তারতম্য় লক্ষ্য করা যায়। জেলার উত্তরদিকের অংশের মাটিতে বালির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে দক্ষিণের দিকে উপকূলের কাছাকাছি অংশে কিন্তু মাটিতে কাদার পরিমান অনেকটাই বেশি। বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য জেলাতেই রয়েছে বটে, সুন্দরবন ব্য়তীত আর তেমন বনাঞ্চল (১.০৪ শতাংশ) নেই বললেই। তবে বিশ্বের দীর্ঘতম ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত বনাঞ্চল কিন্তু বিশেষ করে এই জেলার দক্ষিণ প্রান্তের অবস্থিত অঞ্চলগুলির পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
অর্থনীতি
ঐতিহাসিকভাবে উত্তর ২৪ পরগনার মানুষজন চাষবাসের উপর নির্ভর করেই নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। উর্বর পলিমাটি, নদীর আধিক্য, পর্যাপ্ত বৃষ্টি এখানের চাষবাসের পর্যাপ্ত পরিবেশ গড়ে তুলেছে। ধান, পাট, আলু, গমই এই জেলায় বেশি করে উৎপাদিত হয়। জলাশয়ের আধিক্যের ফলে একসময় ব্যারাকপুর সাব-ডিভিশনের স্থানে স্থানে প্রচুর পরিমানে পাট কারখানা গড়ে উঠেছিল বটে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাটের চাহিদাতে কমেছে। বন্ধ হয়েছে প্রচুর কারখানাও। তাই মানুষজনের অন্যান্য জীবিকার দিকে আগ্রহ বেড়েছে। রাজারহাট এবং সল্টলেকের আইটি হাবগুলি গড়ে ওঠায় জেলার অর্থনৈতিক ছবিটা অনেকটাই বদলেছে।
রাজনীতি
এক সময় ব্যারাকপুর, নৈহাটি অঞ্চল সিপিআইএমের শক্তঘাঁটি ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে এখানকার রাজনৈতিক ছবিটাও বদলেছে। বর্তমানে শাসকদল তৃণমূলেরই দাপট এই জেলায়। তবে বর্তমান সময়ে গেরুয়া শিবিরের প্রভাবও কিছুটা বেড়েছে বটে। জেলায় মোট ৩৩টি বিধানসভা কেন্দ্র ও নয়টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। ৩৩টি বিধানসভার মধ্যে চারটি কেন্দ্রে রয়েছে বিজেপির দখলে, বাকি ২৯টিতেই শাসক দলের প্রার্থীরা বিধায়ক পদে রয়েছেন। অদিতি মুন্সি, রাজ চক্রবর্তী, ব্রাত্য বসুর মতো তারকা প্রার্থীরা একাধিক কেন্দ্রে বিধায়কের দায়িত্বে রয়েছেন।
উল্লেখযোগ্য
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম বড় মিলিটারি ঘাটি উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরেই গড়ে। এই শহরের আনাচে কানাচেও তাই এখনও ব্রিটিশ স্থাপত্যের একাধিক নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত ব্যারাকপুর শহরেই লর্ড ওয়েলেসলির তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছিল এশিয়ার প্রথম চিড়িয়াখানা। যদিও এখন সেই চিড়িয়াখানার ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। এই ব্যারাকপুরই সিপাহী বিদ্রোহের উৎসস্থল বলেও অনেকেই মনে করেন।
বিখ্যাত কলকাতা বইমেলা কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনার বিধাননগরেই আয়োজিত হয়। দেশ, বিদেশের বই পাগুল বহু মানুষ এই মেলার টানে বছর বছর ছুটে আসেন। অবশ্য কলকাতা বইমেলা ছাড়াও, খড়দা, ব্যারাকপুরের মতো স্থানগুলিতেও বইমেলার আয়োজন হয়। এছাড়া খড়দার রাসমেলা, পুষ্প প্রদর্শনী মেলারও বেশ নামডাক রয়েছে।
পর্যটন
নিঃসন্দেহে এই জেলার সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির। হুগলি নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত রানি রাসমানির তৈরি করা এই মন্দির দর্শনে শুধু রাজ্য বা দেশ নয়, বিদেশি পর্যটকরাও কাতারে কাতারে ভিড় জমান। এই মন্দিরের পাশাপাশি শ্যামনগরের মুলাজোর কালীবাড়ি, দক্ষিণেশ্বরের সন্নিকটেই অবস্থিত আদ্যাপীঠেও পুণ্যার্থীরা ভিড় জমান। ব্যারাকপুরেই রয়েছে গাঁধী স্মারক সংগ্রহালয়। জওহরলাল নেহেরুর উদ্বোধন করা গাঁধী ঘাটে নদীর তীরের ফুরফুরে হাওয়া সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য যথেষ্ট। হয়তো এই ক্লান্তি দূর করার জন্যই ব্রিটিশরাও সময়ে সময়ে এই শহরে নিজেদের একাধিক আস্তানা গড়ে তুলেছিলেন। দক্ষিণেশ্বর, গাঁধী স্মারক সংগ্রহালয়ের মতো ঐতিহাসিক স্থানের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে উঠা ইকো পার্কও কিন্তু পর্যটকদের চিত্তাকর্ষণ করে। নিউটাউনে গড়ে ওঠা এই ইকো পার্কে ছোট থেকে বড়, সকলেরই মনোরঞ্জনের উপাদান রয়েইছে। তাই স্বল্প সময়েই পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য় এক বড় আকর্ষণ হয়ে উঠেছে এটি।
অন্যান্য
জেলার বিভিন্ন স্থানে বিশেষত গ্রামের দিকে লোকনাট্য, লোকনৃত্য আজও বহু মানুষের রুজির জোগান দেয়। পুরুষ ও মহিলা, উভয়েই ঝুমুর নৃত্যে তাল,বাঁশির সুরে ছন্দ মিলিয়ে নেচে উঠেন। তার্জগান নামক ধার্মিক কবিতার প্রতিযোগিতাও এক সময় বিরাট জনপ্রিয় ছিল এই জেলার মানুষজনের কাছে। কবিরা গ্রামে-গঞ্জে জড়ো হয়ে মহাভারত, রামায়ণের নানা উপাখ্যান আবৃত্তি করে জণগনকে শোনাতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই চর্চা আজ লুপ্তপ্রায়।
তথ্য সহায়তায়
http://north24parganas.gov.in/index.php
https://barrackpore.cantt.gov.in/history/