Matangini Hazra: ইংরেজবিরোধী কর্মযজ্ঞে সামিল, বানভাসীদের 'গাঁধী বুড়ি' মাতঙ্গিনীর সংগ্রামের নানা অধ্য়ায়
Matangini Hazra Story: মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম ১৮৭০ সালে। তমলুক থেকে সামান্য দূরে হোগলা গ্রামে অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান তিনি। বাবা ঠাকুরদাস মাহাতো, মা ভগবতী দেবী।
কলকাতা: স্বামীর মৃত্যুর পর বৈধব্য জীবনে উত্তরণ। স্বাধীনতা আন্দোলনের মিছিল তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এরপরই শুরু সংগ্রাম। দেশের জন্য লড়াই। চরকা কাটা থেকে লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ, ইংরেজবিরোধী কর্মযজ্ঞে ছিল তাঁর অনায়াস বিচরণ। বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে হয়ে উঠেছিলেন 'গাঁধী বুড়ি'। তিনি মাতঙ্গিনী হাজরা (Matangini Hazra)। স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম ১৮৭০ সালে। তমলুক থেকে সামান্য দূরে হোগলা গ্রামে অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান তিনি। বাবা ঠাকুরদাস মাহাতো, মা ভগবতী দেবী।পরিবারের উপার্জনের একমাত্র পথ ছিল সামান্য কিছু চাষের জমি। সঙ্গী ছিল অভাব অনটন। কোনওদিন পড়াশোনা করার সুযোগই পাননি মাতঙ্গিনী। ১২ বছর বয়সেই বিয়ে। দোজবরে পাঁচ গুণ বেশি বয়সের ত্রিলোচন হাজরার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। কিন্তু সংসার জীবন বেশিদিন টিকল না। মাত্র ৬ বছরের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর স্বামীর। শেষ হল একটা অধ্যায়।
কীভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ?
সে যুগে বিধবাদের জন্য ছিল হাজারও নিয়ম। কড়া সামাজিক অনুশাসনেই দিন কাটছিল মাতঙ্গিনীর। কিন্তু হঠাৎই বদলে গেল ছবিটা। সাল ১৯৩১। মাতঙ্গিনী দেবী দেখলেন তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে এক শোভাযাত্রা এগিয়ে যাচ্ছে। যার মূল আহ্বায়ক গুণধর ভৌমিক নামে স্থানীয় এক কংগ্রেস নেতা। জানলার ফাঁক দিয়ে মাতঙ্গিনী দেখলেন শোভাযাত্রায় কিছু যুবতী এবং কিশোরী শঙ্খধ্বনি দিয়ে স্বাধীনতা দিবসকে আহবান জানাচ্ছেন। জীবন সম্পর্কে এতদিন যে ধ্যান-ধারণা তিনি সযত্নে পোষণ করে এসেছেন সেটা কার্যত বদলে গেল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এই শোভাযাত্রায় তিনি ও শামিল হবেন। তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে নেন মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা। নানা গ্রাম, ছোট বসতি পেরিয়ে পৌঁছলেন কৃষ্ণগঞ্জে। সেখানে একটি সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার শপথ বাক্য পাঠ করলেন। শুরু হল আরও একটি অধ্যায়।
সরকারবিরোধী মিছিলে অংশগ্রহণ থানা, দেওয়ানি ও ফৌজদারী আদালতে চড়াও হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা, এমনকি করবিরোধী প্রচার চালিয়ে যাওয়ার কাজ করে গিয়েছেন তিনি। প্রতিটি দরজায় কড়া নেড়ে বলেছেন কেন ব্রিটিশ সরকারকে এক পয়সাও ট্যাক্স দেওয়া উচিত নয়। ১৯৩২ সালে পুলিশ তাঁকে আটক করে। তবে প্রমাণের অভাবে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। লবণ আইন ভঙ্গের অপরাধেও বেশ কয়েকবার কারাগার বন্দি ছিলেন তিনি। তাঁর মনোভাব দেখে তাবড় কংগ্রেস নেতারাও আশ্চর্য হয়ে যান। ধীরে ধীরে ভরসাযোগ্য হয়ে উঠতে শুরু করেন মাতঙ্গিনী। লেফটেন্যান্ট গভর্নর আন্ডারসন আসবেন তমলুকে। তাঁকে পতাকা দেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় মাতঙ্গিনীকে। পুলিশের কর্ডন ভেঙে পৌঁছে যান নির্দিষ্ট জায়গায়। কালো পতাকা দেখিয়ে তিনি চিৎকার করেন ‘গো ব্যাক গভর্নর, গো ব্যাক’। এই অপরাধে ফের গ্রেফতার করা হয় মাতঙ্গিনী। ছ’মাস পর মুক্তি।
আহত সৈনিকেদর সুস্থ করার ভার নিয়েছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল। তাঁকে বলা হত লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প। প্রায় সমতুল্যই ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। দেশের কাজ করার পাশাপাশি মানুষের সেবাও করেছেন। সেবায় যত্ন দিয়ে পাশে থেকেছেন সবার। সাল ১৯৩৫। বন্যায় ভাসছে তমলুক এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা। বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। দিনরাত এক করে অমানুষিক পরিশ্রম করে রুগণ, আর্ত, গৃহহীনদের সেবা করেছিলেন দেশনারী। তাঁর এই সেবা মুগ্ধ করেছিল সহযোদ্ধাদেরও। দূর থেকে তাঁকে দেখে অসহায় মানুষগুলো বলে উঠত, 'গাঁধী বুড়ি' আসছে। তমলুক সহ ওই পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা তাঁকে সেবার প্রতিমূর্তি হিসেবে 'গাঁধী বুড়ি' বলেই জানতেন। বানভাসী মানুষদের জন্য খাবার জুগিয়ে তবেই সেখান থেকে গিয়েছেন অন্যত্র।
শুধু নিজেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়া নয়, এই কাজে অনেককেই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি। তাঁর দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের অগণিত নারী পিছুটান ফেলে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। ইংরেজ পুলিশের অত্যাচার মেয়েদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার কারাবাস সবই তাঁরা হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন। গাঁধীজীর কুইট ইন্ডিয়া বা ভারতছাড়ো আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই থানা ঘেরাওয়ের কাজ চলত সে সময়। এমনই একদিন মাতঙ্গিনী নেতৃত্বে তমলুক থানা দখলের কর্মসূচি ছিল। তবে এই কর্মসূচিতে প্রাথমিকভাবে মেয়েদের যোগে নারাজ ছিলেন কংগ্রেস নেতৃত্বরা। পরে মাতঙ্গিনীর জেদের কাছে হার মানতে হয় দলকে। ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২। অভিযানের একদিকে মাতঙ্গিনী বাহিনী, অন্যদিকে তৈরি ব্রিটিশ পুলিশও। শুরু হল দুপক্ষের লড়াই। প্রবল গুলি বর্ষণে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সত্তোর্ধ্ব মাতঙ্গিনী। ডান হাত, পরে বাম উরু এবং সবশেষে কপালে গুলি লাগে তাঁর। সে সময়ও তাঁর হাতে মুঠোয় শক্ত করে ধরা ছিল জাতীয় পতাকা। শেষ হল অধ্যায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বল নাম মাতঙ্গিনী হাজরা।
তথ্যঋণ
১. মাতঙ্গিনী হাজরা এবং আরও বীর নারী(দেবল দেববর্মা)
২. https://amritmahotsav.nic.in/unsung-heroes-detail.htm?317
আরও পড়ুন: JU Ragging: যাদবপুরে ফের ব়্যাগিং? ইস্তফার হুঁশিয়ারি অ্যান্টি ব়্যাগিং স্কোয়াডের চেয়ারম্যানের