Independence Day 2023: যখন তখন বিপ্লবীদের নিয়ে হাজির হতেন স্বামী, নিজে না খেয়ে সকলের পেট ভরাতে হতো তাঁকে, সেই স্ত্রী কি স্বাধীনতা সংগ্রামী নন!
Unsung Heroes of Indian Freedom Struggle: কুড়মি সম্প্রদায়ের মেয়ে ভবানীদেবী। মাত্র ন’বছর বয়সে বিয়ে হয় বৈদ্যনাথ মাহাতোর সঙ্গে।

কলকাতা: ঘরে ঘরে টিভি, রেডিও, ফোনের আমদানি ঘটেনি তখনও। দিল্লিতে কী ঘটছে, তা বংলায় এসে পৌঁছতে সময় লাগত ঢের, কখনও একমাস, কখনও বা দু’মাস। তাই বলে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানে বিরত থাকেননি বাংলার তৎকালীন যুবসমাজ। রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা কিনে এনেছিলেন তাঁরা। স্বাধীনতার এত বছর পর তাঁদের মধ্যে কেউ ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছেন, কেউ আবার জনমানসে বিস্মৃত হয়েছেন আগেই। আবার কিছু মানুষ এমনও রয়েছেন, যাঁরা সচক্ষে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ভারতকে মুক্ত হতে দেখেছেন এবং সেই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে রয়েছেন আজও। (Independence Day 2023)
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কতজন এখনও জীবিত রয়েছেন, সরকারি পরিসংখ্যান থেকেও তার সঠিক হিসেব বের করা দুষ্কর। গুলি-বোমা ছোড়েননি, রক্তক্ষয় হয়নি, জেলে যাননি, কিন্তু আড়াল থেকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে অক্সিজেন জুগিয়ে গিয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে সরকারি সিলমোহর মেলেনি যদিও, কিন্তু তাঁরা না থাকলে আরও দীর্ঘতর হতো স্বাধীনতার লড়াই। পুরুলিয়ার মানবাজার ১ নং ব্লকের চেপুয়া গ্রামের বাসিন্দা ভবানী মাহাতো তেমনই একজন ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’। আধার কার্ডে হিসেবের গরমিলে এখনও নবতিপর হলেও, আসলে বয়স ১০৪। ইতিহাসবিদ পি সাইনাথ তাঁর লেখা ‘দ্য লাস্ট হিরোজ: ফুট সোলজার্স অফ ইন্ডিয়ান ফ্রিডম’ বইয়ে ভবানীদেবীর কাহিনি তুলে ধরেছেন। (Unsung Heroes of Indian Freedom Struggle)
কুড়মি সম্প্রদায়ের মেয়ে ভবানীদেবী। মাত্র ন’বছর বয়সে বিয়ে হয় বৈদ্যনাথ মাহাতোর সঙ্গে। ওই ছোট্ট বয়সেই ঘরকন্না, চাষের কাজে হাত পাকিয়ে ফেলেন ভবানীদেবী। স্বামী যুক্ত ছিলেন বিপ্লবী কাজকর্মের সঙ্গে। বাংলার ঘরে ঘরে তখন এমনই দৃশ্য। নিত্যদিন সংবাদপত্র কেনার সামর্থ্য ছিল না সকলের, ঘরে ঘর টিভি, রেডিও, ফোনের বালাইও ছিল না। কোথাও কিছু ঘটলে, লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে ঢের দেরিতে এসে পৌঁছত গ্রামে। তাই ১৯৪২ সালের ৮ অগাস্ট মহাত্মা গাঁধী ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনে’র ডাক দিলেও, চেপুয়া গ্রামে সেই খবর এসে পৌঁছয় ৩০ সেপ্টেম্বর।
আরও পড়ুন: Ramakrishna Meets Vidyasagar : সাগরে মুগ্ধ পরমহংস, কেমন ছিল ঈশ্বরের 'ঈশ্বর' দর্শন ?
গাঁধী আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন শুনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাংলার মানুষও। বৈদ্যনাথও যোগ দেন আন্দোলনে, জেল হয় ১৩ মাসের। স্বামীর অনুপস্থিতিতেও মোটামুটি সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভবানীদেবী। সংসারের রান্নাবান্না থেকে জমিতে রোয়া-বাঁধা, নিড়নো, একাহাতেই সব সামলাচ্ছিলেন তিনি। ফসল কাটা, তা বাড়িতে তুলে আনা, মজুত করা, বাদ রাখেননি কিছুই। কিন্তু সংসারে খাওয়ার লোক বেশি, রোজগারের কম, তাই অভাব-অনটনেই কাটছিল ভবানীদেবীর জীবন। নিরুপায় হয়ে তাই মায়ের কাছে দুঃখ করতেন তিনি, আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতেন।
এর পর ১৩ মাস জেল খেটে বাড়ি ফেরেন বৈদ্যনাথ। কিন্তু স্বামীর মুক্তিতে আরও বেশি ভাবিয়ে তুলেছিল ভবানীদেবীকে। কারণ একটাই, অভাববের সংসারে, যখন তখন, বাড়াভাতে লোক-লস্কর নিয়ে বাড়িতে হাজির হতেন বৈদ্যনাথ। চাল-ডাল, চিঁড়ে-মুড়ি আদৌ আছে কিনা, খবর নিতেন না। শুধু পেটভরে সকলকে খাওয়াতে হবে বলে দিতেন নিদান। কখনও পাঁচ, কখনও ১০, কখনও আবার ২০ জনকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ঢুকতেন বৈদ্যনাথ। তাঁরা সকলেই ছিলেন বিপ্লবী। গোল হয়ে বসে খেতে খেতে ঠিক করতেন নিজেদের রণকৌশল। আর আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজের ভাগ্যকে দুষতেন ভবানীদেবী।
এর পর শ্যালিকা ঊর্মিলাকে বিবাহ করেন বৈদ্যনাথ। ঊর্মিলা ভবানীদেবীর নিজের বোন। তাঁদের দু’জনেরই তিনটি করে সন্তান হয়। বর্ধিত এই সংসারের দায়ও কাঁধে এসে পড়ে ভবানীদেবীর। সংসারে সেই সময় ২০ জনের বেশি লোক। অথচ রোজগারের নামমাত্রও নেই। জমিজমা নিয়েই তাই পড়ে থাকতে হতো ভবানীদেবীকে। রাত ১০টা বা তার কিছু পরে ঘুমাতে যেতেন, আবার ২টোয় ঘুম থেকে উঠে পড়তেন। নিজের প্রথম সন্তানকেও বাঁচাতে পারেননি তিনি। কিন্তু তাঁর এই সংগ্রামের কথা কি পৌঁছেছিল কারও কানে! সংসারের ভারে কাহিল তিনি, অত ভাবার সময় এবং জ্ঞান, কিছুই ছিল না বলে জানিয়েছেন ভবানীদেবী। বরং বৈদ্যনাথ যে দলে দলে লোক নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন, তাঁদের কী খাওয়াবেন, নিজেরা কী খাবেন, তা ভেবে চোখের জলে ভাসতেন বলে জানিয়েছেন।
স্বাধীনতার পর শিক্ষকতা শুরু করেন বৈদ্যনাথ। কিন্তু ভবানীদেবীর সংগ্রাম শেষ হয়নি। বীভৎস আগুনে তাঁদের গোটা খামার ছারখার হয়ে যায়। ফলে মজুত করে রাখা যাবতীয় শস্য ছাই হয়ে যায় পুড়ে। খালিপেটে যাতে কাউকে শুতে না হয়, তার জন্য বাপের বাড়ি থেকে শস্য বয়ে আসেন তিনি। শুধু নিজের পরিবারই নয়, কুড়মি সম্প্রদায়ের অন্যদেরও খাবার জোগান। ১৯৬৪ সালে জামশেদপুর সাম্প্রদায়িক হিংসায় তেতে উঠলে, তার আঁচ এসে পড়ে পুরুলিয়াতেও। সেই সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসা মুসলিমদের নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন ভবানীদেবী। খাতায় কলমে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকা বৈদ্যনাথ স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে স্বীকৃতি পান। কিন্তু স্বামীর মাহাত্ম্যের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যান ভবানীদেবী। সেই নিয়ে যদিও কোনও আক্ষেপ নেই তাঁর। বরং আজকাল আর কেউ কারও জন্য ভাবেন না, বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন শুধু।
ট্রেন্ডিং
সেরা শিরোনাম
