India or Bharat: ‘হিন্দুস্তান’, ‘মেলুয়া’, ‘জম্বুদ্বীপ’, পুরাণ থেকে বেদ, এক দেশের হরেক নাম
India Name Change: বিজেপি-র তরফে সব বাদ দিয়ে, দেশের নাম শুধুমাত্র 'ভারত' রাখার দাবি উঠছে।
নয়াদিল্লি: দেশের নাম নিয়েও বিতর্ক হতে পারে, কিছু দিন আগে পর্যন্ত ভাবা যেত না হয়ত না। কিন্তু বর্তমানে দেশের নাম ঘিরেই রাজনৈতিক তরজা চরমে। সংবিধানে 'ভারত' এবং 'India' দুইয়ের উল্লেখ থাকলেও, বিজেপি-র তরফে সব বাদ দিয়ে, দেশের নাম শুধুমাত্র 'ভারত' রাখার দাবি উঠছে। সংসদে এখনও পর্যন্ত বিল পাস না হলেও, ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু স্বাক্ষরিত জি-২০ সম্মেলনের নিমন্ত্রণপত্রে দেশকে 'ভারত' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইন্দোনেশিয়া সফর এবং ASEAN সম্মেলনেও দেশের নাম 'ভারত' লেখা হয়েছে। (India or Bharat)
সেই নিয়ে রাজনৈতিক তরজা চরমে উঠেছে। বহু ভাষাভাষীর মানুষের বাস যেদেশে, সেখানে সকলের নাগরিক পরিচয় পাল্টে দেওয়ার এই প্রচেষ্টার তীব্র সমালোচনা করছেন বিরোধী থেকে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছেন ইতিহাসবিদরাও। তাঁদের সাফ যুক্তি, বিশ্বের অন্য দেশের মতো, ভারতেরও একাধিক নাম রয়েছে। ঋগ্বেদ থেকে দেশের সংবিধান, সর্বত্রই তার উল্লেখ চোখে পড়ে। তাই একটি রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী, দেশের ১৪০ কোটি নাগরিককে নিজেদের পরিচয় নিয়ে ভাবতে হবে কেন, উঠছে প্রশ্ন। (India Name Change)
ভাষা এবং সংস্কৃতির নিরিখে দেশের নাম কেউ 'ভারত', কেউ 'হিন্দুস্তান', কেউ আবার 'India' বলেন এবং লেখেন। বেদ, পুরাণ, মহাকাব্যেও এই বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী থেকে মহাভারত দেশের নাম কোথাও 'Bharat', কোথাও 'Bharata', কোথাও আবার 'ভারতবর্ষ' লেখা রয়েছে। পুরাণে আবার- দক্ষিণের মহাসাগর এবং উত্তরের বরফের চাদরের মধ্যবর্তী স্থানের উল্লেখ রয়েছে 'Bharata' হিসেবে।
এ প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী ক্যাথরিন ক্লেমেন্তিন-ওঝা যে যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা হল, 'Bharat' বা 'Bharata' নাম ব্যবহারের উদ্দেশ্য যতটা না রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক, তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক। উপমহাদেশের এই অংশে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য ছিল বরাবর। ২০১৪ সালে সেই নিয়ে 'India, that is Bharat...: One Country, Two Names' নামের একটি প্রতিবেদনও লেখেন ক্যাথরিন।
একই ভাবে, প্রাচীন ইতিহাসে রাজা ভরতের উল্লেখ মেলে। ঋগ্বেদে যে 'Bharata' জাতির উল্লেখ রয়েছে, ভরত ছিলেন তাদের পূর্বপুরুষ। তাই উপমহাদেশকে ভারতও বলা হয়। ১৯২৭ সালে নিজের লেখায় ভারতীযয় ঐক্যের সপক্ষে সওয়াল করেন জওহরলাল নেহরু। সেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই উপমহাদেশের ধর্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করেন তিনি। দেশের চতুর্দিকে হিন্দু তীর্থস্থানগুলিরও উল্লেখ করেন।
হিন্দু বলে পরিচয় দেন যাঁরা, তাঁদের কেউ কেউ আবার দেশের নাম 'হিন্দুস্তান' রাখার পক্ষপাতী। যদিও 'হিন্দুস্তান' নামটির উৎপত্তি হয় ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখে। সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা বলা হতো। ইরান এবং গ্রিকদের উচ্চারণে সিন্ধু হয়ে ওঠে 'Indus', 'হিন্দোস' এবং 'ইন্দোস'। সেই থেকেই পরবর্তী কালে 'হিন্দুস্তান' নামের আবির্ভাব। আকিমিনীয় সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টযুগের প্রথম শতকেই 'হিন্দুস্তান' শব্দটির ব্যবহার চোখে পড়ে। সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের বোঝানো হতো তাতে।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আলেকাজান্ডার যখন এ দেশে পৌঁছন, সেই সময় সিন্ধু উপত্যকা পেরিয়েও বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সন্ধু সভ্যতার বিস্তার বলে জানা যায়। মুঘল শাসকদের আমলেও 'হিন্দুস্তান' নামে পরিচিত ছিল দেশ। ইন্দো-গাঙ্গেয় সমতলভূমিকেই বোঝানো হতো তার মাধ্যমে।
ব্রিটিশ শাসকরাই দেশের নাম 'India' রাখে বলে দাবি উঠছে ইতিউতি। তবে এই দাবিও সর্বৈব সত্য নয়। গ্রিক উচ্চারণেই 'Hind' হয়ে ওঠে 'Indus'। আকিমিনীয়দের থেকে সিন্ধু উপত্যকার বাসিন্দাদের সম্পর্কে জানতে পারে গ্রিকরা। সিন্ধু নদ তাদের উচ্চারণে হয়ে ওঠে 'Indus'. সেখান থেকে ইউরোপীয় উচ্চারণে 'India'-র উৎপত্তি ঘটে। ১৮ শতক থেকে 'India' নামটি বহুল প্রচলিত হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশদের প্রকাশ করা মানচিত্রেও ব্যপক ব্যবহার শুরু হয় 'India'-র।
এর বাইরেও, উপমহাদেশের এই অংশ প্রাচীন কালে 'মেলুয়া' নামেও পরিচিত ছিল। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার যে লিপি পাওয়া যায়, তাতে সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতাকে 'মেলুয়া' বলে উল্লেখ করা হয়। সুমেরীয় লিপি উদ্ধার করে দেখা গিয়েছে, হরপ্পা থেকে সেই সময় কাঠ, হাতির দাঁত এবং রত্নসামগ্রী রফতানি হতো। সেই সময় উপমহাদেশকে বলা হতো 'মেলুয়া'। ‘মনুস্মৃতি’তে আবার বর্তমান উপমহাদেশকে ‘আর্যাবর্ত’ বলা হতো, আর্যদের ভূমি বোঝাতে। বৈদিক লিপিতে আবার ‘জম্বুদীপ’ হিসেবেও উল্লেখ মেলে ভারতের, জামগাছ রয়েছে যে দেশে, তা বোঝাতে। আজও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ওই সব লিপি রয়েছে।
জৈন সাহিত্যে আবার ভারতের উল্লেখ রয়েছে 'নবীবর্ষ' হিসেবে। রাজা ভরতের পিতামহ, রাজা নবী। তিনি প্রথম তীর্থঙ্কর হিসেবে গন্য হন। তাঁরা নামানুসারেই উপমহাদেশকে 'নবীবর্ষ' বলা হতো বলে জানা যায়।