গান্ধী, লুথার, লিংকন - তিনজনেরই জীবনাবসান অবশেষে গুলিতে
সদগুরু, ঈশা ফাউন্ডেশন
শুধুমাত্র অঙ্গীকার থাকলেই পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য কাজ করা যায়। মহাত্মা গান্ধী এর একটি চমৎকার উদাহরণ। এই মানুষটিকে যদি দেখেন, দেখবেন তিনি বিশেষ প্রতিভাবান বা তেমন কিছু ছিলেন না, তিনি একজন সাধারণ মানুষই ছিলেন কিন্তু তাঁর অঙ্গীকার ছিল অসাধারণ। তিনি এতটাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে একজন মহামানব হয়ে ওঠেন।
আমার মনে আছে তিনি ভারতের একটি আদালতে তাঁর প্রথম মামলা নিয়ে লিখেছিলেন - যখন তিনি তাঁর যুক্তি দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর হৃদয় ভয়ে কাঁপছিল। স্পষ্টতই তিনি একজন মহান আইনজীবী ছিলেন না, কিন্তু তবুও মানবতার অমূল্য প্রবক্তা তিনি হয়ে উঠেছিলেন ঠিকই। এই মানুষটি পরবর্তীকালে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। শুধু ভারতেই নয়, পৃথিবীর যেকোনও জায়গাতেই গান্ধীর নাম উচ্চারণ করামাত্র একটা শ্রদ্ধার ভাব জাগে। এই সব হয়েছিল এমন একটা সময়ে যখন ভারতে অনেক নেতাই ছিলেন, যাঁরা প্রকৃতই মহামানব ছিলেন। তাঁরা আরও প্রতিভাবান, আরও ভাল বক্তা এবং আরও বেশী শিক্ষিত ছিলেন। তবুও, এই মানুষটি তাঁদের সবার শীর্ষে ছিলেন, কেবলমাত্র তাঁর অক্লান্ত অঙ্গীকারের বলেই।
যা-কিছুই ঘটুক, প্রাণ থাক বা না থাক, প্রতিশ্রুতির পরিবর্তন হওয়া উচিত নয়। প্রকৃত অঙ্গীকার থাকলে, আপনি সব রকমভাবে, সম্পূর্ণভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন। অঙ্গীকারের অভাব থাকলে, আপনি নিজের উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেন। যখন আমাদের এখানে থাকার উদ্দেশ্যই হারিয়ে যায়, তখন কোনও লক্ষ্য পূরণের প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া এমন এক বিষয়, যেটাকে আমরা নিজেদের ভিতরে থেকেই স্থির করতে পারি। আমরা জীবনে যা-কিছুই করব বলে ঠিক করি না কেন, তার প্রতি যদি সত্যিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই, তাহলে প্রচুর ফল আসবে। এবং যদি ফল নাও আসে, যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাঁর কাছে ব্যর্থতা বলে কিছু হয় না। যদি আপনি এক দিনে ১০০ বারও পড়ে যান, আবার উঠে দাঁড়ান এবং এগিয়ে চলুন, এটুকুই যা।
অঙ্গীকার মানে আক্রমণের ভাব নয়। এখানেই মহাত্মা গান্ধীর উদাহরণটি এতো উপযুক্ত হয়ে পড়ে। তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ব্রিটিশ জনগণের বিরুদ্ধে ছিলেন না।
গান্ধী, মার্টিন, লিংকন - প্রত্যেকেরই মৃত্যু গুলিবিদ্ধ হয়ে। এর মাধ্যমে কি আমরা বলতে চাইছি আমাদের এই পৃথিবীতে মহান মানুষদের প্রয়োজন নেই, নাকি প্রমান করছি আমরা তাঁদের যোগ্য নই? অবশ্য, তাঁদের জীবন বৃথা যায়নি।
মার্টিন লুথার কিংয়ের জীবনে ইতি টেনেছিল একটি মাত্র বুলেট, বুলেটটি তাঁর গাল এবং গলা ভেদ করে কাঁধ অবধি পৌঁছেছিল। হত্যাকারীর বুলেট তাঁর জীবনটাই শুধু শেষ করতে পেরেছিল, কিন্তু সবার জন্য সমান অধিকার আনতে এবং আমেরিকাকে বিচ্ছিন্নতা এবং অন্যান্য বৈষম্যমূলক আইনের লজ্জা থেকে মুক্ত করতে তিনি যে উদ্দীপ্ত আগুন জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন তা আজও জ্বলন্ত। মার্টিন লুথার কিংয়ের অবদান ছাড়া আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কখনওই জাতিসংঘে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না। ১৯৬৮ সালের সেই দুর্ভাগ্যজনক দিনে যখন মার্টিন লুথার কিং নিহত হয়েছিলেন, তখন কি কারওর কল্পনা করার সাহস হয়েছিল যে কৃষ্ণাঙ্গ ওবামাকে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হিসেবে একদিন দেখতে পাবেন? এটাই, তাঁর জীবনের শক্তি।
মানুষ পরিকল্পনা করতে এবং স্বপ্ন দেখতে ভয় পায় কারণ তাদের ভয় হল সবসময়, "যদি এটা না ঘটে, তাহলে কী হবে?" - এই আশঙ্কা। যদি “এটা না ঘটে”, কিছুই হবে না; কিন্তু “যদি এটা ঘটে” তাহলে অত্যন্ত চমৎকার হবে। প্রত্যেকেরই স্বপ্ন আছে, কিন্তু কতজন সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য নিজের জীবন বাজি রাখতে ইচ্ছুক? যা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু তৈরি করতে নিজের জীবন দিয়ে দেওয়ার জন্য, আসন্ন আগামীকালকে গড়তে আজকের আরামকে ত্যাগ করার জন্য সাহস এবং প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য কোন জিনিসটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটা স্পষ্টভাবে দেখতে পাড়ার ক্ষমতাই সাধারণ মানুষদের থেকে মহান মানুষদের আলাদা করে দেয়।