এক্সপ্লোর

Independence Day Exclusive : 'আমার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে যেন একটি করে শহিদ তৈরি হয়'

Freedom Fighter Praydot Bhattacharya : বহু বিপ্লবীর আত্মবলিদানের ফসল দেশের স্বাধীনতা। অল্প বয়সেই দেশমাতার সেবায় নিজেদের নিযুক্ত করেছেন যেসব বিপ্লবী, তাঁদের মধ্যে একজন প্রদ্যোৎ কুমার ভট্টাচার্য।

মেদিনীপুর : একজনের চোখে চশমা, সিঁথিটা অন্যদিকে। অপরজনের মোটা গোঁফ, মালকোঁচা মারা ধুতি। ছদ্মবেশ নিয়ে পৌঁছলেন মেদিনীপুর জেলা বোর্ডের মিটিংয়ে। সেই মিটিংয়ে তখন সভাপতিত্ব করছেন অত্যাচারী ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস। চারদিকে পাহারদার। এর উপর আবার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত ডগলাসও সঙ্গে রেখেছিলেন রিভলভার। এত কিছু সত্ত্বেও প্রচণ্ড সাহসিকতার সাথে সভাস্থলে ঢুকে পড়লেন দুই তরুণ বিপ্লবী-একজন প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য, অপরজন প্রভাংশুশেখর পাল। প্রহরীরা বিশেষ কিছু আঁচ করার আগেই একেবারে তড়িতের বেগে ডগলাসের পিছনে হাজির দু'জনে। গর্জে উঠল রিভলভার। দ্রাম, দ্রাম। নিমেষে খতম অত্যাচারী ইংরেজ শাসক। 

এর পর সভাস্থলে উপস্থিত কেউ কেউ তখন নিজের নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। তবে, দুই বিপ্লবীকে কম-বেশি সবাই দেখলেন। একজন অল্প বয়স্ক, কিশোর। অন্যজনের দারোয়ানের মতো গোঁফ, বেশ স্বাস্থ্য়বান যুবক। ডগলাসকে খতম করেই দৌড় শুরু দুই বিপ্লবীর। এদিকে তাঁদের ধরতে পেছন পেছন দৌড়চ্ছে প্রহরীরাও। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর বিপ্লবীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাল সেপাইরা। লক্ষ্যভ্রষ্ট হল গুলি। প্রচণ্ড শব্দে বিপ্লবীদের কানের পাশ দিয়ে পেরিয়ে যায়।

পাল্টা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালাতে থাকেন গোঁফওয়ালা যুবক। অর্থাৎ প্রভাংশুশেখর পাল। পুলিশের নজরের বাইরে চলে যান। কিছুটা গিয়েই টান মেরে ফেলে দেন গোঁফ। নাড়াজোল রাজবাড়ির পাশের একটি দিঘিতে ফেলে দেন জুতো। এর পর নির্জন কালভার্টের নিচে লুকিয়ে রাখেন রিভলভার ও কার্তুজ। সেখান থেকে সোজা চলে যান মামারবাড়ি।

কিন্তু, পালাতে পারলেন না প্রদ্যোৎ। রিভলভার সাথ দেয়নি তাঁকে। বিগড়ে যায়। তাড়া করতে থাকে পুলিশ। ঘুরে বেশ কয়েকবার পাল্টা ফায়ার করার চেষ্টা করেন প্রদ্যোৎ। কিন্তু, গুলি বেরোয়নি। এই পরিস্থিতিতে কাছেই একটি পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। বহু সংখ্যক সেপাই ঘিরে ফেলে সেই বাড়িটি। সেখান থেকে বেরিয়ে ফের পালানোর চেষ্টা। কিন্তু, স্থানীয় অমর লজের কাছে রাস্তায় ছিটকে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে প্রদ্যোৎকে ঘিরে ফেলে নিরাপত্তারক্ষীরা। তাঁর পকেট থেকে পাওয়া গেল দুটি কাগজের টুকরো। যার একটিতে লেখা, "হিজলী হত্যার ক্ষীণ প্রতিবাদে-ইহাদের মরণেতে ব্রিটেন জানুক। আমাদের আহুতিতে ভারত জাগুক-বন্দেমাতরম।"

অপরটি ইংরাজিতে লেখা -‘A fitting reply to premeditated and prearranged barbarous & cowardly attempt on the patriotic sons of Bengal— Bengal revolutionaries.’

প্রদ্যোৎ কুমার ভট্টাচার্য। ডাকনাম, কচি। ১৯১৩ সালের ২ নভেম্বর মেদিনীপুর শহরের আলিগঞ্জে জন্ম। অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুরের গোকুলনগরে ছিল তাঁর পৈতৃক ভিটে। বাবা ভবতারণ ভট্টাচার্য। সম্ভ্রান্ত পরিবার। ধীর-স্থির ও বুদ্ধিমান প্রদ্যোৎ ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন প্রথম বিভাগে। সেই বয়স থেকেই বিপ্লবী চেতনা দানা বাঁধে প্রদ্যোতের মধ্যে। ঘুণাক্ষরেও বিষয়টি টের পাননি বাবা । 

ম্যাট্রিকে ভাল ফল করার পর ভর্তি হলেন মেদিনীপুর কলেজে। মেদিনীপুরে সেই সময় সক্রিয় হয়ে উঠেছে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স(BV)। বিপ্লবী কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়ায় চাপে ছিল অত্যাচারী ইংরেজরা। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বিপ্লবী-সান্নিধ্যে আসা প্রদ্যোতের। সংস্পর্শে এসেছিলেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের। নজরে পড়েন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তর। তাঁকে সংগঠনের সদস্য করা হয়। শুধু তাই নয়, প্রদ্যোতের বাড়ির পাশেই থাকতেন ক্ষুদিরামের দিদি অপরূপা দেবী। প্রায়ই তাঁর কাছে চলে যেতেন প্রদ্যোৎ। শুনতেন ক্ষুদিরামের গল্প। এসবের মধ্যে দিয়েই বিপ্লবী সত্ত্বা তৈরি হয়ে যায় প্রদ্যোতের। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। 

এদিকে মেদিনীপুরে তখন বিপ্লবী কার্যকলাপে তটস্থ ইংরেজরা। সালটা ১৯৩১। এপ্রিলের এক সন্ধ্যা। জেলা স্কুলের শিক্ষা প্রদর্শনীতে হাজির থাকা মেদিনীপুরের অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট জেমস প্যাডির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্ত, জ্যোতিজীবন ঘোষরা। গুলি চালিয়ে খতম করা হয় প্যাডিকে। কিন্তু, পিছু হটেনি ইংরেজরা। আরও অত্যাচারী এক শ্বেতাঙ্গ অফিরাসকে মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট করে পাঠানো হয়। রবার্ট ডগলাসকে। সক্রিয়তা বাড়ে ইংরেজদের। এর পর সেই হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দিদের উপর অত্যাচারের প্রেক্ষাপট। ১৬ সেপ্টেম্বর বন্দিদের উপর চলে গুলি। শহিদ হন বিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত, সন্তোষকুমার মিত্ররা। অনেকে আহতও হন। আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে। ডগলাসকে খতম করার পরিকল্পনা ছকে ফেলে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। যার দায়িত্ব চাপে প্রদ্যোৎ কুমার ভট্টাচার্য ও প্রভাংশুশেখর পালের উপর। সেই দায়িত্ব নিষ্টার সাথে পালন করেন এই দুই বিপ্লবী।
 
কিন্তু, ধরা পড়ে যান প্রদ্যোৎ। প্রাথমিকভাবে পালাতে সক্ষম হলেও কলকাতায় গ্রেফতার হন প্রভাংশুশেখর। পরের দিনই তাঁকে নিয়ে আসা হয় মেদিনীপুরে। কিন্তু, জেলা বোর্ডের কেউ তাঁকে শনাক্ত করতে পারেনি। বেকসুর খালাস পেয়ে যান প্রভাংশুশেখর। কিন্তু, জেল হয় প্রদ্যোতের। সেখানে তাঁর উপর শুরু হয় অমানবিক অত্যাচার। সব রকম চেষ্টা করেও মুখ খোলা যায়নি প্রদ্যোতের। নখে পিন ফোটানো, লাঠির আঘাত...সবকিছু সহ্য করেছেন মুখ বুজে। কিন্তু, 'মন্ত্রগুপ্তি' রক্ষা করে গেছেন। এমনকী মানসিক অত্যাচারেও তাঁকে টলানো যায়নি। কিন্তু, ডগলাস হত্যা মামলার বিচারে ফাঁসির আদেশ হয় তাঁর।

কালকুঠুরিতে থেকেই মা-কে চিঠি লিখেছেন প্রদ্যোৎ। লিখেছেন,  "মাগো, আমি যে আজ মরণের পথে আমার যাত্রা শুরু করেছি তার জন্য কোনও শোক কোরো না। ... যদি কোনও ব্যারামে আমায় মরতে হত তবে কী আপশোশই না থাকত সকলের মনে। কিন্তু আজ একটা আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন করছি, তাতে আনন্দ আমার মনের কাণায় কাণায় ভরে উঠছে, মন খুশিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে...।"

মাত্র ২০ বছরের ছোট্ট জীবন। হ্যাঁ, ২০ বছর। ১৯৩৩ সালের ১২ জানুয়ারি ফাঁসির দিন ঠিক হয় প্রদ্যোতের। স্থান, মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল। ঘড়িতে তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে স্নান সেরে শেষবারের মতো তৈরি ভারতমাতার বীর সন্তান প্রদ্যোৎ। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও সে কী মানসিক বল, দেশমাতার প্রতি ভালোবাসা। ডগলাস পরবর্তী ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ তাঁকে তিনি তৈরি কি না প্রশ্ন করেন। যার উত্তরে প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য বলেছিলেন- "তৈরি থেকো বার্জ। এরপর তোমার পালা। " জেলের বিভিন্ন সেল থেকে প্রদ্যোতের নাম উঠল জয়োধ্বনি। দুই দাদা প্রভাতভূষণ ও শক্তিপদ দেখেন সেই দৃশ্য।

ফাঁসির আগের দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন রাজবন্দি কৃষ্ণলাল চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে কানে কানে জানতে চেয়েছিলেন, 'ভাই, কাউকে কিছু বলবার আছে কি ?' এর উত্তরে প্রদ্যোৎ বলেছিলেন, 'আমার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে যেন একটি করে শহিদ তৈরি হয়।'

ফাঁসির অপেক্ষায় অপেক্ষমান প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্যের মা পঙ্কজিনীদেবীকে লেখা চিঠির অংশ দিয়েই শেষ করতে হয়। যেখানে বিপ্লবী লিখেছেন, "মা তোমার প্রদ্যোৎ কি কখনও মরতে পারে ? আজ চারিদিকে চেয়ে দেখো, লক্ষ লক্ষ প্রদ্যোৎ তোমার দিকে চেয়ে হাসছে। আমি বেঁচেই রইলাম, মা অক্ষয় অমর হয়ে- বন্দেমাতরম...।"

আরও দেখুন
Advertisement
Advertisement
Advertisement

সেরা শিরোনাম

Bangladesh: অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ, মৃত আত্মীয়র নামে নথি তৈরি, পুলিশের জালে আরও এক বাংলাদেশি
অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ, মৃত আত্মীয়র নামে নথি তৈরি, পুলিশের জালে আরও এক বাংলাদেশি
Kolkata Traffic: বড়দিনে শহরে যান নিয়ন্ত্রণ, কোন কোন পথে চলবে না গাড়ি, ফাঁকা থাকবে কোন রুট?
বড়দিনে শহরে যান নিয়ন্ত্রণ, কোন কোন পথে চলবে না গাড়ি, ফাঁকা থাকবে কোন রুট?
Partha Chatterjee: 'আপনাদের জন্যই দেরি হচ্ছে, দরকারে রাত জেগে কাজ করুন', পার্থর বিরুদ্ধে চার্জগঠনে বিলম্ব, তিরষ্কৃত ED
'আপনাদের জন্যই দেরি হচ্ছে, দরকারে রাত জেগে কাজ করুন', পার্থর বিরুদ্ধে চার্জগঠনে বিলম্ব, তিরষ্কৃত ED
Shyam Benegal Demise: বিখ্যাত চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল প্রয়াত
বিখ্যাত চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল প্রয়াত
Advertisement
ABP Premium

ভিডিও

Recruitment Scam:আজ নিয়োগ দু্র্নীতিকাণ্ডে CBI-র মামলায় পার্থর জামিনের আবেদনের রায়দান ABP ANANDA LIVEBangladesh News : 'পুলিশ তথ্য প্রদান করলে তবেই উপরমহল সেই তথ্য বিকৃত করতে পারে', বললেন দেবাশিস দাসRG kar: 'পুলিশ কি অপরাধীদের ধরবে,না অভয়ার ন্যায়বিচার চেয়ে চলা প্রতিবাদ বন্ধ করবে?',প্রশ্ন চিকিৎসকেরRG Kar Incident : চিকিৎসকদের অবস্থান-বিক্ষোভ নিয়ে সিঙ্গল বেঞ্চের রায় বহাল রাখল ডিভিশন বেঞ্চ

ফটো গ্যালারি

ব্যক্তিগত কর্নার

সেরা প্রতিবেদন
সেরা রিল
Bangladesh: অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ, মৃত আত্মীয়র নামে নথি তৈরি, পুলিশের জালে আরও এক বাংলাদেশি
অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ, মৃত আত্মীয়র নামে নথি তৈরি, পুলিশের জালে আরও এক বাংলাদেশি
Kolkata Traffic: বড়দিনে শহরে যান নিয়ন্ত্রণ, কোন কোন পথে চলবে না গাড়ি, ফাঁকা থাকবে কোন রুট?
বড়দিনে শহরে যান নিয়ন্ত্রণ, কোন কোন পথে চলবে না গাড়ি, ফাঁকা থাকবে কোন রুট?
Partha Chatterjee: 'আপনাদের জন্যই দেরি হচ্ছে, দরকারে রাত জেগে কাজ করুন', পার্থর বিরুদ্ধে চার্জগঠনে বিলম্ব, তিরষ্কৃত ED
'আপনাদের জন্যই দেরি হচ্ছে, দরকারে রাত জেগে কাজ করুন', পার্থর বিরুদ্ধে চার্জগঠনে বিলম্ব, তিরষ্কৃত ED
Shyam Benegal Demise: বিখ্যাত চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল প্রয়াত
বিখ্যাত চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল প্রয়াত
IND vs AUS 4th Test: হাঁটুর চোট সেরেছে, তবে মেলবোর্নে নিজের ব্যাটিং পজিশন নিয়ে ধোঁয়াশা বজায় রাখলেন রোহিত শর্মা
হাঁটুর চোট সেরেছে, তবে মেলবোর্নে নিজের ব্যাটিং পজিশন নিয়ে ধোঁয়াশা বজায় রাখলেন রোহিত শর্মা
Partha Chatterjee: পার্থর জামিনের আর্জি খারিজ হয়ে গেল ফের, রাজ্যের ভূমিকায় প্রশ্ন কলকাতা হাইকোর্টের
পার্থর জামিনের আর্জি খারিজ হয়ে গেল ফের, রাজ্যের ভূমিকায় প্রশ্ন কলকাতা হাইকোর্টের
WB Dengue: পিছু ছাড়ছে না ডেঙ্গি আতঙ্ক, চিন্তা বাড়াচ্ছে উত্তর ২৪ পরগনার পরিসংখ্যান
পিছু ছাড়ছে না ডেঙ্গি আতঙ্ক, চিন্তা বাড়াচ্ছে উত্তর ২৪ পরগনার পরিসংখ্যান
South 24 Paragana News: 'সেফ প্যাসেজ' বাংলা ? বাংলাদেশে কীভাবে পালানোর ছক কষেছিল ধৃত সন্দেহভাজন জঙ্গি ?
'সেফ প্যাসেজ' বাংলা ? বাংলাদেশে কীভাবে পালানোর ছক কষেছিল ধৃত সন্দেহভাজন জঙ্গি ?
Embed widget